সিজোফ্রেনিয়া

ভোর পাঁচটার মতো হবে। সকালের আলো তখনো স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। কেবল মানুষের ছায়াগুলো বোঝা যায়। চার পাঁচ জন লোক এসে মেয়েটিকে তাদের সাথে নিয়ে গেলো। সাথে মেয়েটির বাবাও যাচ্ছে। জ্বীন হুজুরের নির্দেশ। ভোর হবার আগেই মেয়েটিকে, হুজুরের আস্তানায় নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, জ্বীনরা রেগে যাবে। মেয়েটির উপর তারা বেশি অত্যাচার করবে। বাবা মা সারা রাত ধরে বসে থেকে সেই ব্যবস্থাই করেছে। সকাল হবার আগেই মেয়েকে হুজুরের বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছে। দুই তিন দিন যাবত পরিকল্পনা করে, মেয়েটির বাবা-মা আজ ভোরের সময়টিই ঠিক করেছে।

এর আগে হুজুরের এক ভক্তের মাধ্যমে হুজুরের সাথে দেখা করেছে। ভক্তের অনুরোধে হুজুর একটু বেশি সময় দিয়েছে এবং বিষয়টিকে তাড়াতাড়ি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হুজুরের কাছ থেকে বের হয়ে ভক্তটি বাকি বিষয়গুলি বাবা মাকে বুঝিয়ে বলেছে। মেয়েটিকে এমনকি অন্য কাউকেও এসব কথা জানানো যাবেনা। তাতে করে, জ্বীনরা মেয়েটির উপর ক্ষেপে গিয়ে কি করে তা বুঝা মুশকিল। তাই বাবা মা, সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথেই আজকের এই ব্যবস্থা করেছে। কেউ টের পাবার আগেই মেয়েটিকে হুজুরের বাড়ীতে নিয়ে আসতে পেরেছে। এখন অপেক্ষা কখন জ্বীন মেয়েটিকে ছেড়ে যাবে।

মেয়েটি কয়েকদিন সেখানে থাকার পর সত্যিই জ্বীন তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটি এখন অনেক দুর্বল, বেশ কয়েক দিনের ধকল গেছে মেয়েটির উপর দিয়ে। জ্বীনরা যত রকমের অত্যাচার করা যায় সবই করেছে মেয়েটির উপর। মেয়েটি মুখ দিয়ে খাবার খেলেও খাবারগুলো গেছে জ্বীনদের পেটে। ঘুম সব জ্বীনরা কেড়ে নিয়েছে। ভাগ্যিস জ্বীন হুজুরের খবর আগে ভাগেই তারা পেয়েছিল এবং সেই মতো দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। তা না হলে, আরো কয়েকদিন যদি এভাবে চলতো তবে মেয়েটির যে কি হতো। যাহোক জ্বীন এখন চলে গেছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্য জায়গায়। জ্বীন চলে যাবার সময় মেয়েটির মাথায় বেশকিছু ক্ষতি করে গেছে। সেসব ঠিক করতে হলে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সেটা ঠিক করতে পারে।

মা বাবা আবার অসহায় বোধ করছে, কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করবে। হুজুর মা বাবাকে চিন্তা করতে বারণ করেন। তার পালিত জ্বীনদেরকে আবার ডাকলো। এবার হুজুরের পালিত জ্বীনরা বলে দিলো, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। একজনের নামও জ্বীন বলে দিলো। বাবা মা হাফ ছেড়ে বাঁচলো, যা হোক হুজুর সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছে। এখন মাথার সমস্যা সারলেই চলে।
এখানে আরো অনেক কথা আছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কি ওষুধ দিয়েছে সেটা হুজুরকে দেখাতে হবে। হুজুর বললে, মেয়েকে ওষুধ খাওয়ানো হবে। না করলে ওষুধ বন্ধ।

গল্পটি নিতি নামের (কল্প নাম) ১৭ বছরের একটি চঞ্চল চটপটে মেয়ের। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিনী। বড় দুই ভাইবোনও এখনো পড়াশুনা করছে। নিতিও এসএসসি পাশ করেছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা ঢাকায় কোনো একটি কলেজে পড়বে। নিতিও তাই চায়। ঢাকায় মামার বাসায় উঠেছে, এখানে থেকে আপাতত কলেজে ইন্টারভিউ দিবে। পরবর্তিতে ভর্তি হয়ে কোনো একটি হোস্টেলে উঠে যাবে, এমনি ইচ্ছা। মামার বাসায় প্রথম কয়েকদিন ভালো থাকলেও, কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। নিতি কারো সাথেই কথা বলেনা। বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ বসে থাকে। পড়াশুনাও ঠিক মতো করেনা। মামী প্রথমদিকে কিছু বলেনি। মনে করেছে, নিতির মামা বা মা-বাবা মাইন্ড করতে পারে। মনে করতে পারে, মামী তাকে তাদের বাসায় রাখতে চায়না বলেই হয়েতো বদনাম করছে।

কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অদ্ভুত সব কান্ড করতে থাকে। সবাই যখন কাজে ব্যস্ত থাকে নিতি তখন চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢুকে ভাত ভর্তি হাড়িতে পানি ঢেলে দেয়। মামী প্রথমে দুই একবার বুঝার চেষ্টা করছে, বিষয়টি কি? দিন দিন বাড়তেই থাকে। মামী মামাকে বলে, মামাও খেয়াল করলো আগের মতো কথা বলেনা। শুধু তাকিয়ে থাকে। মামার সন্দেহ হলো, মনে হয় ঢাকা এসে এখানে ঠিক মতো এডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলো, কয়েক দিনের জন্য বাড়ীতে পাঠিয়ে দেবে। তারপর আবার নিয়ে আসবে। কিন্তু বাড়ীত গিয়ে নিতির পাগলামী আরো বেড়েছে। এবার দিন বা রাতের বেশিরভাগ সমই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। কখনো এমনকি খাটের নীচেও চলে যায়। বাথরুমে যেতে চায়না, পেশাব পায়খানা অন্য কোথাও করবে। বাথরুমে যাবেনা। বাবা মা মুশকিলে পড়েছে। আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশী কয়েকজন এসে দেখে নিশ্চিত হয়েছে নিতিকে জ্বীনে ধরেছে। মনে হয় ঢাকায় যাবার রাস্তায় বা ওখান থেকেই কোনো ভাবে ধরেছে। তারপরই তারা জ্বীন হুজুরের স্মরনাপন্ন হয়েছে।

রোগটি আসলে সিজোফ্রেনিয়া
বেশ কয়েকটি ঘটনাই এমন ঘটেছে। জ্বীন হুজুর কোনো একজন বিশেষজ্ঞের নাম সহ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের আউটডোরে পাঠিয়েছে। তারা এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে আবার হুজুরের কাছে অনুমতি নিয়ে ওষুধ খাওয়া শুরু করেছে।

এখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, রোগের সচেতনতা কখন থেকে শুরু করা দরকার? কাদের সচেতন হতে হবে প্রথম? এমনতর সমস্যার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কারা নিবেন? চিকিৎসকদের দায় দায়িত্ব আসলে কতটুকু?

সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত মানুষজন রাগ, সন্দেহ, একা থাকা, একা একা হাসা, একা একা কথা বলা সহ বিভিন্ন ধরনের অসংগতিপূর্ণ আচরণ এবং কাজ করে থাকতে পারে। তারা নিজেরা ভাবতে পারেননা, এটা একটা রোগ। তই ওষুধ খাওয়া বা চিকিৎসা নেবার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেন না। তারা কানে সরাসরি কথা শুনেন, যেখানে আসলে কেউ নেই। সেই অদৃশ্য মানুষটাকে তারা সত্যি মনে করেন এবং তাদের সাথে কথা বলেন। রাস্তায় হাটার সময় মনে করে সব মানুষ তাদেরকে নিয়ে কথা বলছে। এমন অনেক রকমের অসংগতি ও অসংলগ্ন আচরণ তারা করেন। বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত বিশ্বাস তার করেন, যার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক নাই। একেক জন একেক রকমের বিশ্বাস করেন এবং সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই চলেন। সাধারণত; ১৫ থেকে ২৫ বছরের বয়সে রোগটা শুরু হয়। তবে অন্য যেকোনো সময়ও হতে পারে।

মেয়েটি হঠাৎ করেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে। রোগ হঠাৎও হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও হতে পারে। তবে, যত কম বয়সে হয় চিকিৎসা ততই কঠিন। সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয়, চিন্তার রোগ। সাধারণত ভুল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই এই রোগের সিম্পটম প্রকাশ পায়। আসেপাশের মানুষজন সেটা মিলাতে পারেনা। তখনই বিভিন্ন কিছু মনে করেন। জ্বীনের আছর কিংবা বান মারাও এসব চিন্তার মধ্যে থাকে।

রোগকে রোগ হিসেবে দেখতে হবে। মেয়েটির এমনতর অদ্ভুত আচরণের প্রধান কারণ তার ভ্রান্ত বা ভুল বিশ্বাস। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডিলুশন’। মেয়েটি বিশ্বাস করতো, ভাতে কেউ বিষ দিয়ে গেছে এবং ভাতগুলো শুধু ওর জন্যই রান্না করা হয়েছে। তাই সে ভাতে পানি ঢেলে দিত। মনে করতো সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি করতে চাইছে তাই সে ঘরে বন্ধি হয়ে থাকতো এবং কারো সাথে মিশতনা। তার ধারণা ছিল বাথরুমে গেলেই তাকে আটকে দেয়া হবে, সেখানেই তাকে মেরে ফেলা হবে।

সিজোফ্রেনিয়া সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলার আছে। শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করেই শেষ করতে চাই। রোগটি যত তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে, চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে ততই মঙ্গল। আক্রান্ত মানুষটি এবং তার পরিবারের জন্য ততই ভালো। সিজোফ্রেনিয়াকে ভালো করে জানলে, অন্যান্য অনেক মানসিক রোগ সম্মন্ধেও জানা হয়ে হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআমি ছেলে হয়েও ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি
Next articleশিশু কিশোরদের বিষণ্নতায় মিউজিক থেরাপি!
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here