সন্তান পালনে সফলতা- শেষ পর্ব

0
33

যে ইচ্ছা আমাদের সবার মনেই প্রবলভাবে থাকে এবং যে ইচ্ছা সহজে পূরণও হয় তা হলো সন্তান লাভের ইচ্ছা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাই প্রায় বাবা-মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। সন্তান পাবার ইচ্ছা পূরণ সহজ হওয়ায় অনেক সময়ই আমরা এই প্রাপ্তির গুরুত্বকে উপলব্ধি করি না। নিঃসন্তান দম্পতির দীর্ঘশ্বাস আমাদের এই প্রাপ্তির গুরুত্ব জানিয়ে দেয়। এত সাধের পাওয়া সন্তানের লালন পালন নিয়ে আমরা কতটা সচেতন তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের যত্ন নেয়া, সন্তানকে শেখানো, তাকে কোনো কিছু করতে গাইড করা এ সবই ব্যক্তির জ্ঞান ও অভিরুচি এবং পরিবারের নিজস্ব সংস্কৃতি বা কালচারের উপর নির্ভর করে। তাদের কেউ কেউ অতিরিক্ত কড়া শাসনে বিশ্বাসী। আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত উপদেশ নির্দেশ দিয়ে ছেলে মেয়েকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কেউবা অতিরিক্ত ছেড়ে দেন। শিশু যা চায় তাই দেন, যা করতে চায় তাই করতে দেন। অর্থাৎ শিশু অতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাস থেকে যারা সন্তান লালন পালন করেন তারা সাধারণত নিজের আচরণের যুক্তি খোঁজেন না। নিরপেক্ষ ভাবে নিজের আচরণের প্রভাবকে বিশ্লেষণ করেন না। ফলে শিশু যখন অগ্রহণযোগ্য বা অসামাজিক আচরণ করে তখন চরম বিষ্ময়ে প্রশ্ন করেন, “এসব তুমি কার কাছে শিখেছো?”

১ম পর্বের পর…

পারিবারিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ
প্রতিটি পরিবারের কিছু মূল্যবোধ ও রীতিনীতি থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারই এগুলোর প্রতি সচেনত থাকেন না। সচেতনতার অভাবেই সন্তান এমন মূল্যবোধ ও রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যা মা-বাবা চান না। আমার পরিবারে মূল্যবোধ ও রীতিনীতিগুলো ঠিকমতো মেনে চলা হয় না, ফলে সন্তানরা সেগুলো শেখে না। তাই মা-বাবা হিসবে ভালো মূল্যবোধ ও রীতিনীতিকে খুঁজে বের করে তা অনুশীলন করতে হবে।

তথ্যের আদান প্রদান
পরিবারকে এমন হতে হবে যেখানে মা-বাবা সহ পরিবারের অন্যান্যরা একত্রে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। যেমন- রাজনৈতিক, পরিবেশের খবর, আনন্দের সংবাদ, খেলার খবর ইত্যাদি খাবার টেবিলে বা পারিবারিক আড্ডার বিষয় হতে পারে। এছাড়া পরিবারের বাজেট, অসুস্থতাজনিত খরচ, মেহমানের ব্যবস্থা এবং পারিবারিক সংকটের বিষয়েও সন্তানদের সাথে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এতে সন্তানরা ভালোভাবে পরিবারকে বুঝতে পারে, পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব বাড়ে এবং এতে করে সন্তানের মধ্যে অতিরিক্ত চাওয়ার ইচ্ছা থাকে না।

বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা
সন্তানের প্রতি আমাদের সবারই প্রত্যাশা থাকে। আমরা চাই আমাদের সন্তান লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল করবে, স্বীকৃত বিষয়ে পড়াশোনা করবে, মনোযোগী হবে, ফলাফলের দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে যাবে এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রত্যাশা থাকা প্রয়োজন কিন্তু তা হতে হবে বাস্তবসম্মত। আমরা অনেকেই সন্তানের ক্ষমতার বাইরে এমন প্রত্যাশা করি যার পরিণতিতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, তারা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, লেখাপড়ায় অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং নিজের জীবনের কোনো লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। তাই সন্তানের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা হতে হবে বাস্তবসম্মত।

নিজস্ব সত্ত্বা
আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব সত্ত্বা বা নিজস্বতা রয়েছে। আমরা সবাই একই ভাবে চিন্তা করি না, একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই, পছন্দ/অপছন্দ এক নয়, একই স্বপ্ন দেখি না, আমার আমাদের আচরণে ও আবেগে রয়েছে বিভিন্নতা। আমাদের মতো আমাদের সন্তানদেরও রয়েছে নিজস্ব সত্ত্বা। সবাই যেমন একই রকম আচরণ করে না তেমনি লেখাপড়াতেও সবাই সমান দক্ষ নয়, বুদ্ধিমত্তা, বিষয়ের পছন্দ/অপছন্দ, শেখার ধরন, শেখার কৌশল এই সবকিছুই একেকজনের একেক রকম হয়। তাই প্রথমত নিজের সন্তানকে চিনতে হবে এবং কঠোর ভাবে দুটি জিনিষকে পরিহার করতে হবে। একটি হলো সবার প্রতি একই প্রত্যাশা না রাখা এবং একজনকে অপরজনের সাথে তুলনা না করা।

পরিমিতিবোধ
পরিমিতিবোধ আমাদের অনেক সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কথায় ও কাজে বাড়াবাড়ি না করে বরং সংযম রক্ষা করে মাঝামাঝিতে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। পরিমিতিবোধ থাকলে পরিবারের অহেতুক অশান্তি হয় না এবং সন্তানও পরিমিতিবোধের প্রকাশ ঘটাতে শেখে।

অংশগ্রহণ
মা-বাবার মতো সন্তানদেরও হতে হবে পরিবারের সক্রিয় সদস্য। এর ফলেই তাদের মধ্যে পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও পরিবারের প্রতি একাত্মতা গড়ে উঠবে। পরিবারের সন্তানদের সক্রিয় সদস্য করার প্রক্রিয়া হিসেবে তাদের সব কাজের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ থাকতে হবে। পরিবারে ছোট-বড় নানা রকম কাজে সব সদস্য একত্রে বসে পরিকল্পনা করলে একেকজন একেক কাজের দায়িত্ব নিবে, দায়িত্ব পালন করবে এবং কে কত ভালোভাবে কাজটা করেছে তার মূল্যায়নও করবে। এতে একদিকে যেমন পরিবারের সাথে সম্পর্ক শক্ত হবে অপরদিকে সন্তানদের পরিকল্পনা করার, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার এবং মূল্যায়ন করার দক্ষতাও বাড়বে।

সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা
সন্তানের সামাজিক দক্ষতা তৈরির ব্যাপারে মা-বাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবারের বাইরের লোকের সাথে মিশতে, বন্ধুত্ব তৈরিতে, বন্ধুত্ব রক্ষায়, শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে মা-বাবার সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে। সন্তানের যদি বন্ধুর সাথে কোনো সমস্যা হয় তবে মা-বাবা সন্তানকে বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে না বলে বরং বন্ধুর সাথে সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতে হবে।

মজা করা
পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে মজার মজার কথা বলার অভ্যাস করতে হবে যেখানে তারা তাদের সেন্স অব হিউমার বা রসবোধের ব্যবহার করতে পারেন। রসবোধের ব্যবহার পারিবারিক পরিবেশকে সহজ ও সুন্দর করে। এতে পরষ্পরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং পরিবারে সবাই সবার উপস্থিতিকে উপভোগ করে।

ধর্মের প্রতি বিশ্বাস
মানসিকভাবে সুস্থ থাকার একটি উৎকৃষ্ট উপায় হলো ধর্মের প্রতি বিশ্বাস। ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে, কম খরচ করতে, খারাপ কাজ বন্ধ করতে, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, শৃঙ্খলাবোধ জন্মাতে, মানসিক চাপ কমাতে এবং মনের শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। পরিবারে ধর্মের  সত্যিকার বিশ্বাস ও চর্চা সন্তানকে সঠিকভাবে লালন পালনে ইতিবাচক/ভালো ভূমিকা রাখে। তবে ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস মানুষের মনকে ছোট করে, ফলে মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ঠিকমতো বুঝতে পারে না, সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসে না এবং ধর্মীয় রীতিনীতি ঠিকমতো পালন করতে পারে না। ধর্মের প্রতি একেবারে অন্ধ থাকলে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে না।

সফল ভাবে সন্তান গড়ে তোলার জন্য এই সমস্ত বিষয় ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। যেমন- সততা, সত্যনিষ্ঠতা, ধৈর্য্য, পরিপক্কতা ও সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলা ইত্যাদি। এছাড়াও সফল মা-বাবা হওয়ার জন্য আরও প্রয়োজন হচ্ছে,

√ শিশুর বিকাশ ও শিশুর যত্নের কৌশল সম্পর্কে জানতে হবে।
√ নিজের সীমাবদ্ধতা ও গুণগুলো খুঁজে বের করে, সীমাবদ্ধতাকে দূর করার এবং দক্ষতাকে বাড়ানোর ইচ্ছা থাকতে হবে।
√ জানা তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিকে সন্তানের সাথে ভালো উপায়/কৌশলগুলোকে নিয়মিত অনুশীলন করতে শিশু বান্ধব গৃহ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআপনি উদ্বেগাধিক্য নামক মৃদু মানসিক রোগে ভুগছেন
Next articleমানসিক রোগ থেকে ফিরে আসার গল্প

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here