ডা পঞ্চানন আচার্য্য
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।
(১)
নিলয় খুবই আমুদে আর বহির্মুখী একটা ছেলে। বন্ধুবান্ধব, পাড়ার লোকজন সবার সাথেই তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। যখন যেখানেই ডাক পড়ে, এমনকি ডাক না পড়লেও নিজে থেকে জড়িয়ে পড়ে এর-ওর সহায়তায়। বাবা-মা এই “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” স্বভাব নিয়ে বকাবকি-রাগারাগি করে করে এখন ক্ষান্ত দিলেও, বিয়ে করা বউ-এর সাথে প্রায়ই মনোমালিন্য, ঝগড়া বেঁধে যায়।
এই যেমন সেদিন পাশের বাসার ভাবীর প্রসব বেদনা উঠলে, পুরো এপার্টমেন্টে কেউই বের হলো না। কিন্তু নিলয় হট্টগোল শুনে বের হলো এবং সমস্যা বুঝে নিজেই গাড়িতে করে নিয়ে গেল হাসপাতালে। রাত দুইটায় বাসা থেকে বের হয়ে, সব শেষ করে ঘরে ফিরল পরদিন ভোর সাতটায়। এসেই অফিসের তাড়াহুড়ো শুরু করলে তার স্ত্রী আর সহ্য করতে পারল না, ঝগড়া লেগে গেল।
ঘরে নিজের বাচ্চার জ্বর ফেলে অন্যের সেবা করতে যাওয়াকে তার স্ত্রী মানুষের কাছে বাহবা পাওয়ার লোভ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। আর নিলয় কোনোভাবেই বুঝাতে পারছে না, বাসায় কোনো পুরুষ সদস্য উপস্থিত না থাকায় একজন প্রসূতির কষ্ট অগ্রাহ্য করে অন্যরা থাকতে পারলেও সে নিজেকে এতটা অমানবিক ভাবতে পারে না।
(২)
খোরশেদ সাহেব ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। নিম্নবিত্ত বাবার অকালমৃত্যুর পর সাত ভাইবোনকে বড় করা, পড়ানো, প্রতিষ্ঠিত করা-এসব করতে করতে আজ নিজেই জীবনের পড়ন্ত বিকেলে। কখনোই সেই অর্থে নিজের সুখ তো দূরের কথা, নিজের স্ত্রীর সাধ-আহ্লাদ, ছেলেমেয়ের আবদার নিয়েও ভাবেননি বা ভাবতে পারেননি। আজ তাঁর সব ভাই-বোনই প্রতিষ্ঠিত, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বড় অবস্থানে। উলটো তিনিই আজ অবস্থানের দিক থেকে সবার নীচে, একজন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী।
কোনো রকমে দিন চলে তাঁর এবং নিজের সংসারের। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত খোরশেদ সাহেব প্রায়ই সমালোচনার শিকার হন ভাইবোনদের কাছ থেকে। সবারই বক্তব্য ঘুরে ফিরে এটাই যে, উনি সংসারের জন্য অতিরিক্ত কিছুই করেননি; যা করেছেন সেটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
কার কী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেননি, কে কী অভাবে ছিল, সেটার ফিরিস্তিই আজ ঘুরে ঘুরে বাজতে থাকে রেকর্ডের মতো। বাবা হিসেবে নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে না পারার জন্য ছেলেমেয়েরাও কথায় কথায় শুনিয়ে দেয় যে, ভাইবোন করতে করতে নিজের ছেলেমেয়েদের কথা মনে না রাখা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামী। খোরশেদ সাহেব তাই নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন-ভাইবোনরাও কি তাহলে পর? তাদের জন্য নিজের জীবনের এত বড় অংশ ব্যয় করাটা কি আসলেই বোকামী ছিল?
(৩)
একটা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন রাশেদ সাহেব। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অবসরের আগ পর্যন্ত যখন যেভাবে পেরেছেন, সবার সাথেই মিলে মিশে, সবার সুখে দুঃখে থাকতেন তিনি। সারাদিনই সহকর্মী, সাহায্যপ্রত্যাশী মানুষজনের ভরসার জায়গা হিসেবে তাঁর চারপাশে ভিড় লেগেই থাকত। সবার মুখে তাঁর সততা, কঠোর নিয়মনিষ্ঠা প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়েই ছিল।
তিনি নিজেও মন-প্রাণ দিয়ে নিয়োজিত থাকতেন এসব নিয়েই। বয়সের কারণে সফলভাবে দুই বছরের কিছু বেশি সময় আগে অবসরে গেছেন তিনি। শুরুর দিকে কিছুটা লোকজনের আলোচনায় থাকলেও বর্তমানে একেবারেই নিঃসঙ্গ, একাকী। আগে মাঝে মাঝে কলেজে যেতেন ঘুরতে, কথা বলতে। কিন্তু দিনে দিনে উপস্থিত অন্য সকলের অস্বস্তি, উষ্মা, বিরক্তি বুঝতে পেরে গুটিয়ে নিয়েছেন সেখান থেকে। এখন তাঁর কাছে কেউ আর আসে না কোনো দরকারে, এমনকি তাঁর খবর নেয়ার জন্যেও না।
জীবন সায়াহ্নে এসে তাই কেবলই মনে হয়-অন্যের জন্য কাজ করাটাই জীবনের সব বলে ভেবে আসা কি ঠিক ছিল না? জ্ঞাতসারে বা স্বেচ্ছায় কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি, কোনো লোভ থেকে কাজ করেননি। রাষ্ট্র তাঁর উপর ভরসা করে দায়িত্ব দিয়েছে ভেবে এবং পবিত্র দায়িত্ব মনে করে নিষ্ঠার সাথে শুধু করে গেছেন। তাহলে কেন করলেন এসব? এতদিন যে মানুষজন তাঁর প্রশংসা করে এসেছে, তারা সবাই কি তাহলে শুধু ক্ষমতার কারণে প্রশংসা করত? এগুলো কি আসলেই মিথ্যা? তিনি যা করেছেন বা ভেবেছেন, সেসব কি অদরকারী?
উপরে যে কয়েকজনের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, তাঁদের সবারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যার নাম – পরার্থপরতা। ইংরেজিতে ধষঃৎঁরংস। পরার্থপরতা হলো অন্যের কল্যাণে কাজ করা, প্রয়োজনে নিজের স্বার্থকে তুচ্ছ করে। পরার্থপরতা অন্যদের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগী চিন্তা ও প্রচেষ্টা।
এটি সাহায্য করার ইচ্ছা থেকে কাজ করা, যার জন্য কোনো ব্যক্তিগত লাভ বা পুরস্কারের আশা থাকে না, বরঞ্চ যা প্রায়ই নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরার্থপরতার আচরণ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন দাতব্য কাজ, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম, বা কোনো ব্যক্তিকে সমর্থন প্রদান করা। এটি হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় যে কোনো পর্যায়ে।
বলা হয়, পরার্থপরতা, বা আত্মত্যাগ, একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ। কিন্তু, দিন শেষে যখন হিসাব নিকাশের বিষয় আসে, ফেলে আসা জীবনকে বা সময়কে বিশ্লেষণ করে মানুষ বুঝতে চায় জীবনে কি পেলাম, কি হারালাম-তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে-এই যে পরার্থপরতা, এর কি কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?
সত্যিকার অর্থে পরার্থপরতার অনেক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, বিশেষ করে এই যে আত্মমগ্ন এবং ‘আত্মসুখী, পর-বৈরাগী’ নীতির দিকে কুৎসিতভাবে ধাবমান বর্তমান পৃথিবীতে। পরার্থপরতার প্রয়োজন রয়েছে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রেই।
শুরুতেই ব্যক্তিগত পর্যায়। উপরের যে তিনটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, পরার্থপরতায় ব্যক্তিগত জীবনে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয় এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পরার্থপরতায় ব্যক্তিজীবনেও অনেক উপকারিতা আছে। যখন আমরা অন্যদের জন্য কিছু করি, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন অনুভব করি।
গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যদের সাহায্য করলে আমাদের মনোভাব উন্নত হয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা আমাদের স্বার্থপরতা ও অভ্যাসগুলোকে পরিবর্তন করি, যা আমাদের আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করে। পরার্থপরতা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে দৃঢ় করে। এটি আমাদের শেখায় কিভাবে অন্যদের অনুভূতি ও প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব দিতে হয়।
যখন আমরা পরার্থপরতার সঙ্গে জীবন যাপন করি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের নিজেদের সুখ অন্যদের সুখের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই উপলব্ধি আমাদেরকে আরো বেশি সহানুভূতিশীল এবং বিবেকবান করে তোলে। অন্যের জন্য করা কাজগুলো এভাবে আমাদেরকে দিনশেষে সুখী রাখে।
পরার্থপরতা আমাদের সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে। যখন মানুষ পরস্পরের জন্য কাজ করে, তখন তা একটি সংহতিশীল পরিবেশ গড়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যখন দুঃস্থদের সাহায্য করে, তখন সেই কাজটি শুধুমাত্র সাহায্য নয়, বরং অন্যদের মধ্যে এক ধরনের উদারতা এবং সহানুভূতির বোধ সৃষ্টি করে।
ফলে, সমাজের মধ্যে মানবিক সম্পর্কগুলোর উন্নতি হয় এবং মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানেও পরার্থপরতা সাহায্য করে। আমাদের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে, যেমন দারিদ্র্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সংকট।
এই সমস্যা সমাধানে যদি মানুষ পরার্থপরতার সঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা একটি স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারি। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এমনভাবে কাজ করে, যেখানে পরার্থপরতা তাদের মূল ভিত্তি। তাদের কর্মকাÐ সমাজের দুর্বল অংশের জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে পরার্থপরতা আমাদের সমাজকে আরও সমৃদ্ধ এবং মানবিক করে তোলে।
তাহলে, উদাহরণের তিনজন মানুষের মতো আমাদের মনেও পরার্থপরতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দ্বিধা বা সন্দেহ কেন আসে? এক্ষেত্রে, কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। প্রথমত: এটা সঠিক যে পরার্থপরতা সব সময় সম্ভব নয় এবং কখনও কখনও নিজের স্বার্থকে আগে রাখতে হয়। এই জায়গাটাতে এসে পরার্থপরতার সাথে দ্ব›দ্ব হয়। ধরা যাক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণ করতে যাওয়ার মুহূর্তটা। তিনি যদি মারা যান তাহলে তাঁর পরিবারের হাল কী হবে?
এমনকি অর্থবিত্তের সমস্যা না থাকলেও, সবার সহযোগিতা থাকলেও তাঁর সন্তানদের বাবার অভাব কিভাবে পূরণ হবে? দ্বিতীয়ত: এমন চরম কোন বিষয় না হলেও, একজন পরার্থপর মানুষ স্বাভাবিকভাবে এইসব কাজেই বেশি আগ্রহ পান এবং সেখানেই যুক্ত থাকেন। যেহেতু কাজগুলো প্রচুর সময়, মনোযোগ এবং শ্রমনির্ভর- তাই তাঁর উপর নির্ভরশীল মানুষদের ভাগে সময় এবং মনোযোগের ঘাটতি হয়।
এখন এই মানুষগুলো যদি প্রশ্ন তুলেন, দাবী করেন তাঁদের যেটা ন্যায্য অধিকার- তখনও সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত: পরার্থপর মানুষের সংখ্যা আসলেই অনেক কম। ফলে, যে পরার্থপর মানুষটা অন্যদের জন্য স্বভাবগতভাবে প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে ফেলেন, তাঁর বিপদে বা দরকারে অন্য কেউ কিন্তু প্রায়শই এগিয়ে আসে না। এমনকি বোকা বা অন্য অনেক নেতিবাচক মন্তব্যে তাঁকে এবং তাঁর আপনজনদের বিপর্যস্ত করে তুলেন। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- কী লাভ পরার্থপরতায়।
এক্ষেত্রে, আমাদের মনে রাখতে হবে, পরার্থপরতার মূল কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু নয়- তাই ব্যক্তিগত লাভক্ষতির পাল্লায় মাপলে আমরা সঠিকভাবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারব না। এবং আমরা সবাই যদি পরার্থপরতার চর্চা করি, সমাজটাই যদি পরার্থপর হয় – তবে পরার্থপর হওয়ার কারণে কাউকে পরবর্তীতে আর দ্বিধাগ্রস্ত হতে হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরার্থপরতার মাধ্যমে আমরা একে অপরের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারি।
এটি মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে, সমাজকে উন্নত করে এবং আমাদের নিজেদের জীবনকেও অর্থবহ করে তোলে। তাই, পরার্থপরতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি একটি অপরিহার্য গুণ। এটি আমাদের জীবনে, সমাজে এবং মানবতার জন্য অত্যন্ত দরকারি। আমাদের উচিত পরার্থপরতা চর্চা করা এবং একে জীবনযাত্রার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করা।
আরও পড়ুন-