অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি সেই অন্ধকার আর এই আলো

0
43
নিকটজনের আকস্মিক মৃত্যুতে কী ধরনের মানসিক পরিবর্তন হয়?

ডা. তৈয়বুর রহমান রয়েল
রেসিডেন্ট, এমডি (সাইকিয়াট্রি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষায়িত শাখা হিসেবে সাইকিয়াট্রি আজকে যে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, গোড়াতেই এমনটা ছিল না। মনের চিকিৎসা শ্রাস্ত্রের এই আবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে হাজার রকমের গল্প। সবচেয়ে কঠিন ও মনোযোগ আকর্ষণ করা অধ্যায়টিই সম্ভবত ‘অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি’, এই আলোচনার মূল বিষয়।

মানসিক রোগীদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে জন্ম নেওয়া এই আন্দোলন শুধু অধিকার আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং কালক্রমে এটি ‘অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি’ নাম ধারণ করে সাইকিয়াট্রি বিষয়টিকেই খুব কঠিন এক প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছিল। কখনো এর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেউ কেউ।

বলেছে সাইকিয়াট্রি বিষয়টিরই আসলে কোনো শারীরিক ভিত্তি নেই, সব কল্পকাহিনী। দিয়েছে অপবিজ্ঞানের তকমাও। কেউ কেউ বলেছে এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সূক্ষ্ম হাতিয়ার মাত্র। পুঁজিবাদীরা বলেছে সাইকিয়াট্রি সমাজতন্ত্রীদের দোসর আবার সমাজতন্ত্রীরা বলেছে একে পুঁজিবাদের মারণাস্ত্র।

সময়ে সময়ে অদ্ভুত সব চিকিৎসা পদ্ধতি একে একে যোগ হয়েছে এর ভেতর। পানিতে চুবিয়ে রাখো, বেধড়ক পেটাও, নয়তো স্পিনিং চেয়ারে লাটিমের মতো ঘোরাও। ইনসুলিন কোমা থেরাপি, ইলেকট্রিক শক।

বাপ রে! নাকের ফুটো দিয়ে হাতুড়ি-বাটাল সহযোগে ব্রেনে অস্ত্রোপচার। আবার কখনো কখনো শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ঢুকিয়ে দাও। ধরনী দ্বিধা হও! এসবের নাম নাকি চিকিৎসা!! এসব কি কখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানের অংশ হতে পারে? আলবত না।

গল্পটা এখান থেকে সময়ের কারণে একটু উল্টো করে দেখতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, অর্থাৎ ভুলে গেলে চলবে না, তখন না ছিল কোনো ওষুধ, না ছিল অন্য কোনো কার্যকর বা বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি। ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরার মতো তৎকালীন চিকিৎসকরা ধরতেন একেকটা পদ্ধতি।

কিছু তো ফল পাওয়া যাবে, এই আশায়। মারমুখী আক্রমণাত্মক এসব মানুষকে একটু শান্ত তো করা যাবে! এভাবেই চলতে থাকে বিভিন্ন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া আর চিকিৎসা পদ্ধতি। সময় যেতে যেতে একদিন আবিষ্কার হয় ক্লোরপ্রোেমাজিন, মানসিক রোগ চিকিৎসার প্রথম ওষুধ। সাইকিয়াট্রি প্রবেশ করল নতুন যুগে। পায়ে পায়ে এলো আরো নতুন নতুন ওষুধ- ইমিগ্রামিন, ক্লোজাপিন, ডায়াজিপামসহ আরো অনেক। কিন্তু সমালোচনা তখনো বন্ধ হয়নি। বলা হতে লাগল এসব তো ওষুধ না, যেন মৃত্যুবটিকা।

ভালো তো করেই না, উল্টো তিলে তিলে শেষ কওে দেয়। আরো অনেক কথা। সব পুঁজিবাদী দৈত্যগুলোর ষড়যন্ত্র। বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো বাঘা বাঘা সাইকিয়াট্রিস্টদের মাথা কিনে এসব করছে। কিন্তু সময় এবং সাইকিয়াট্রি থেমে থাকেনি। অনেক প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। সমাধান করেছে অনেক রহস্যের। বাকি রয়ে গেছে আরো অনেক রহস্য।

তো কী? সময়মতো সব প্রশ্নের উত্তর পাব নিশ্চয়ই। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই, তবে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। কী অসহায়ই না ছিল আমাদের পূর্বসূরিরা। কী বন্ধুর পথই না পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের। পথের বাঁকে বাঁকে রোমহর্ষক, উত্তেজনায় ঠাসা গল্প। আমরা ধারাবাহিকভাবে এর একেকটি অবগুণ্ঠন সরিয়ে উন্মোচন করব একেকটি না বলা অধ্যায়। এবারের পর্ব ‘ট্র্যাপেটোম্যানিয়া’।

উনবিংশ শতাব্দী। সময়, ইতিহাসের টাইম মেশিনে চড়ার। গন্তব্য মার্কিন মুল্লুক। দক্ষিণের স্টেটগুলোতে কৃষিজমির চাষবাস ও তুলাশিল্পে কাজের জন্য প্রচুর লোকের প্রয়োজন হতো। কোথায় পাওয়া যাবে এত লোক? জমজমাট হয়ে উঠল দাস ব্যবসা। তৎকালে ওই জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল দাস। মূলত পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আনা হতো তাদের।

দাস বোঝাই একেকটি জাহাজ পাড়ি দিত আটলান্টিকের এপার-ওপার। কোনোটার গন্তব্য দক্ষিণ আমেরিকা, কোনোটার ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, আর কোনোটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অসম্ভব দুঃখজাগানিয়া এক পারাপার। জাহাজের ডেকে গাদাগাদি করে রাখা হতো সব দাস। উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ। হাতে-পায়ে শিকল পরানোর কারণে খুব বেশি নড়াচড়ার সুযোগ নেই। তার ওপর জ্বরজারি, ডায়রিয়া, স্কার্ভি লেগেই থাকত। এ যেন সাক্ষাৎ নরক।

কখনো কখনো এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত পথেই মারা যেত। অর্ধমৃত, মলমূত্রমাখা নগ্ন এই দাসেরা যখন উপকূলে পৌঁছাত তখন আর মানুষ বলে চেনার উপায় থাকত না। এই যে মানুষের পরিচয় ঘুচল, আর কখনোই পুরো মানুষ হয়ে উঠতে পারত না তারা। পেত না মানবিক সম্মান আর মর্যাদা। সারাদিন ক্ষেত-খামার, মিল- ফ্যাক্টরিতে উদয়াস্ত পরিশ্রম, অপুষ্টি, অন্যান্য মৌলিক চাহিদার অভাব, আবার পান থেকে চুন খসলেই চাবুকের ঘায়ে রক্তাক্ত হওয়াই যেন ছিল এদের নিয়তি।

কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। ফলে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই চাইত পালাতে। কেউ কেউ সফলও হতো। চলে যেত উত্তরের স্টেটগুলোতে, যেখানে দাস ব্যবসা তেমন একটা ছিল না। কেউ যেত কানাডায়। মিলত কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। আহা! কী শান্তি! এই স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি অবশ্য সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি।

অনেকের কাছেই তা ছিল গুরুতর অপরাধ। কেউ কেউ আবার ভাবতেন এই পালিয়ে যাওয়া আসলে এক ধরনের মানসিক রোগ। এমনই একজন Dr. Samuel Adolphus Chartwright. লুইজিয়ানার স্বনামধন্য এই চিকিৎসক এর নাম দেন ড্যাপেটোম্যানিয়া (Drapetomania). Drapes= পালিয়ে যাওয়া (দাস) আর Mania উন্মত্ততা। অর্থাৎ উন্মাদ দাস, যে মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চায়। কী সাংঘাতিক! তাই না? ভদ্রলোক অবশ্য একে বৈজ্ঞানিক (অ) দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করেছেন।

তৎকালীন New Orleans Medical & Surgical Journal-এ প্রকাশ করেছেন তার নিবন্ধ ‘Diseases & Peculiarities of the Negro Race. এরপর রিপোর্ট পেশ করেছেন Lousiana Medical Association-এ। পড়ে যায় তুমুল হৈচৈ। তাই তো তাই তো, এই ভয়ানক রোগের ফলেই এই নচ্ছার কালো ঊনমানুষগুলো গণ্ডায় গণ্ডায় পালায়। এই তাহলে ব্যাপার! বেড়ে চলল সার্কুলেশন।

বহুল প্রচারিত De bow’s review-তেও প্রকাশিত হলো এই আর্টিকেল। রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গেলেন Samuel Chartwright. অবশ্য নিন্দামন্দও কিছু হলো। সেটা অবশ্য নর্দার্ন স্টেটগুলোতে। ওদের তো আর দাস লাগে না, এই আর কী? ডাক্তার সাহেব অবশ্য ধর্ম, বিজ্ঞান সব এক করেছেন। বলেছেন, বাইবেল মতে একজন দাস সব সময় মালিকের বাধ্য থাকবে। ফলে কখনোই পালাতে চাইবে না।

এরপরও যদি পালায় সে রোগ নয়তো আর কী? এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছেন যেসব মালিক একটু বেশি মানবিক, যারা এই ঊনমানুষগুলোকে লাই দিয়ে মাথায় তোলেন তারাই শেষে ভুক্তভোগী হন। সুতরাং নো বেশি ভালোমানুষি। দাস তো দাস, থাকবে মাথা নিচু করে।

তাকে আবার কেন মাথা উঁচু করতে দেওয়া? বুঝি না বাপু! এই রোগের লক্ষণও ভয়ঙ্কর। মুখ ভার করে থাকা, অকারণেই অসন্তুষ্টির ভাব। বাপ রে বাপ, সাবধান এ যখন-তখন পালাবে। তিনি এর সমাধানও বাতলে দিতে ভুল করেননি।

কল্পনা করেন তো কী সেটা? ঠিক ধরেছেন। মাইরের ওপর ওষুধ নাই। চাবকে একেবারে বাঁকা করে দাও। তারপরও পালাবি? দেব দু’পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে। এবার পালা তো দেখি। এর কিন্তু প্রতিষেধকও রয়েছে, আর তা হলো দাসদের রাখতে হবে বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা করে।

আগলে রাখতে হবে শিশুর মতো। দয়া-মায়া, মনুষ্যত্বের বয়ানও দিয়েছেন অবশ্য। শুনতে কেমন বেমানান লাগে। তাই না? কী নিষ্ঠুর! একদম বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ। সব পূর্বপুরুষদের ঋণ। এখনো শোধ দিতে হচ্ছে। আরো কতদিন দিতে হবে কে জানে?

Previous articleবাসের ধাক্কা ও বাচ্চাদের চিৎকার… এরপর থেকে সহজে ঘুম আসে না
Next articleআলো আমার একেবারেই সহ্য হচ্ছে না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here