ডা. টুম্পা ইন্দ্রাণী ঘোষ
এম.বি.বি.এস, বিসিএস (স্বাস্থ্য),
এম.ডি (বিএসএমএমইউ), সহকারী অধ্যাপক, শিশু—কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, লাইফস্প্রিং।
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতির ফলে দিনদিন সহজলভ্য হয়ে উঠছে নানা প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ শিশু—কিশোরদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে শিক্ষার বিরাট মাধ্যম যেমন হতে পারে, অন্যদিকে সৃষ্টি করতে পারে মারাত্মক আসক্তি। নিত্য—নতুন প্রযুক্তি বা গেজেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়া মোটেও দোষের কিছু নয়। তবে স্মার্টফোন, ট্যাব বা কম্পিউটারের মতো স্মার্ট ডিভাইসগুলো যখন শিশুদের আনন্দের একমাত্র উপকরণ হয়ে যায় তখন সেটা আসক্তির পর্যায়ে পড়ে। যেকোনো ধরনের আসক্তিই শিশুদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশুর মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। এ আসক্তির কোথা থেকে শুরু? এর শুরু হয় শিশুর আধো আধো বুলির সময় স্মার্টফোন তুলে দেয়ার মাধ্যমে। কান্নারত শিশুকে থামাতে সেই যে ফোন তুলে দেয়া হয়েছিল তার থেকে ধীরে ধীরে অভ্যাস ও আসক্তিতে চলে যায়। যে কথা অভিভাবকদের অজানাই থেকে যায়, যখন জানা হয় তখন সন্তান রীতিমতো ‘বিগার গ্যেয়া!’ প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে জানেন না। বাবা-মা সন্তানদের সময় কম দেওয়ার কারণে ৮৫ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে। তাছাড়াও খেলার মাঠের অভাবে ৫২ শতাংশ এবং খেলার সাথীর অভাবে ৪২ শতাংশ শিশু স্মার্টফোনের দিকে আসক্ত হচ্ছে।
জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩গুণ। অভিভাবকরা কেন সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন? কারণ সন্তানরা স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকলে তারা দ্বিধাহীন কাজ করতে পারেন। তাছাড়া স্মার্টফোন দিলে বাচ্চাদের খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানো সহজ হয়। শিশু অতিরিক্ত স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের সমস্যা বাড়ছে। শিশুদের অল্পতেই রেগে যাওয়া, বিষণ্ণতা, মনোযোগের অভাব এর সবই অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে হয়ে থাকে। শিশুর অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহারের বেলায় অভিভাবকের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিশুর ডিভাইস ব্যবহারে অভিভাবকদের কোথায় কোথায় সচেতন হতে হবে?
১. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন
শিশুদের যদি কোনো ডিভাইস দেয়া হয় তাহলে সেটিতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই—মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করাটাই নিরাপদ হবে। গুগলে একটা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সিস্টেম আছে। যা ব্যবহার করে শিশু কী দেখছে তার উপর নজরদারি করা সম্ভব।
২. কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ ইন্সটল করুন
প্যারেন্টাল সেফ ব্রাউজার একটি অ্যাপ আছে। এটা শিশুর ডিভাইসে ইন্সটল করা হলে কোনো ধরনের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট দেখতে পারবে না শিশু। ইউটিউব কিডস নামে একটি অ্যাপ আছে যেটি শিশুদের কথা মাথায় রেখেই কন্টেন্ট তৈরি করে। তবে এটি এখনো বাংলাদেশে নেই। অনেক সময় দেখা যায় যে, বাবা বা মায়ের ডিভাইস—ই শিশু ব্যবহার করে থাকে। সেক্ষেত্রে সেফ ব্রাউজার—প্যারেন্টাল কন্ট্রোল নামে একটা অ্যাপস আছে। সেটি মোবাইল, ল্যাপটপ বা পিসিতে ইন্সটল করলে যখন বাচ্চারা ব্যবহার করবে তখন সেটি চালু করে রাখা সম্ভব। এই অ্যাপটি অ্যানাবল—ডিজাবল করার অপশন আছে। এটি প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায়। সিকিউরিটি বিষয়ক আরও অ্যাপস আছে যেগুলো ইন্সটল করে রাখলে অন্যান্য অ্যাপসেও যাতে অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট না আসে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পিসি বা ল্যাপটপের ব্রাউজারে আলাদা ছোটো প্লাগ—ইনসের মতো ‘ব্রাউজার এক্সটেনশন’ ইন্সটল করে রাখলে সেটিও অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট আসা বন্ধ করে দেয়। এমনকি সার্চ করলেও পাওয়া যাওয়া যাবে না। এসব ‘ব্রাউজার এক্সটেনশন’ ফ্রিতে পাওয়া যায়।
৩. ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় বেঁধে দিন
শিশুরা কতক্ষণ অনলাইন বা ইন্টারনেটে থাকবে তার একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া উচিত। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ বাসায় কখন কখন থাকবে আর কখন থাকবে না সেটির একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। হতে পারে সকাল, বিকাল কিংবা রাতে ১৫—৩০ মিনিট করে। যদি শিশু বিষয়টি পজেটিভভাবে দেখে তাহলে তাকে বোনাস হিসাবে ৫—১০ মিনিট সময় বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এতে তার মন ভালো থাকবে।
৪. চাইল্ড ভার্সন অপশনটি ব্যবহার করুন
ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের চাইল্ড ভার্সন আছে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেয়া যায় যেটি তারা ব্যবহার করলেও অভিভাবকদের সুপারভাইজ করার সুযোগ থাকে। ফেসবুকে বাচ্চাদের ব্যবহারের জন্য একটা অপশন আছে। মেসেঞ্জারেও অপশন আছে। সেখানে কেউ আপনার বাচ্চাকে অনুরোধ বা রিকোয়েস্ট পাঠালে আপনার কাছেও সেটি আসবে। আপনি অনুমতি দিলে তারা চ্যাট করতে পারবে।
৫. ইন্টারনেট সংযোগ নেয়ার সময় সচেতন হোন
বাংলাদেশে বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছেন যারা ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকেন। তবে যে কোম্পানির কাছ থেকে ইন্টারনেট সংযোগটি নেয়া হচ্ছে তাদের কাছে বাচ্চাদের জন্য সেফ ইন্টারনেটের ফিচারটি আছে কিনা সেটি যাচাই করে নেয়াটা ভালো।
৬. শিশুর সাথে আপনিও অংশ নিন
ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় আপনিও শিশুর সাথে বসুন। শিক্ষামূলক বিভিন্ন চ্যানেল এবং ওয়েবসাইট রয়েছে। তাদেরকে সেগুলো দেখতে উৎসাহিত করুন। নতুন কিছু শিখতে বা তৈরি করতে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলুন। এখন বিভিন্ন সাইট, ইউটিউব কিংবা অন্য সাইটগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী যে বিষয়গুলো দেখে সেই একই ধরনের বিষয় বা কন্টেন্টগুলোই পরামর্শ বা সাজেশান্স হিসেবে আসতে থাকে।