গত পর্বে একটি প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে আমার লেখাটি শেষ করেছিলাম । প্রশ্নটি হলো ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যার জন্য মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে কেন যাবে একজন রোগী? প্রশ্নটির পাশাপাশি একজন রোগীর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দ্বিধাও লক্ষ করা যায়। আর তা হলো মানসিক বিশেষজ্ঞ মানেই তো পাগলের ডাক্তার, যৌন সমস্যা নিয়ে তার কাছে যেতে হবে!
অবশ্য এ ধরনের দ্বিধার কারণও আছে।
এ দেশে মানসিক বিশেষজ্ঞদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল পাবনা মেন্টাল হসপিটাল থেকে। এখনো পরিচিত কেউ পাগল হয়ে গেলে তাকে নিয়ে পাবনা দৌড়াবার প্রবণতা আমাদের আছে। তাই এরকম চিন্তাটাই প্রথমে চলে আসে।
প্রকৃতপক্ষে পাগল বা সাইকোসিস যেমন একটি মানসিক রোগ তেমনি ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা, অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা, ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যাও একেকটি মানসিক রোগ। এরকম প্রায় ৪৫০টি মানসিক রোগ রয়েছে। একেকটি রোগ একএকটি মানসিক অবস্থা নির্দেশ করে।
সর্বপ্রথম রিচার্ড ভন ক্রাফট এবিং এ বিষয়ে মনোযোগী হন। ১৩৮টি কেসহিস্ট্রি নিয়ে সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কেসহিস্ট্রিগুলো ছিল বিকৃত যৌনতার। চিকিৎসার বিষয় ছিল সেইসব বিকৃতির। নারীরা যৌন সক্রিয় না হয়ে ওঠা পর্যন্ত যৌনরোগ বলতে এসব যৌন বিকৃতিই বোঝাত। যেমন ধর্ষকামিতা, মর্ষকামিতা, সমকামিতা ইত্যাদি। তাই মানুষের যৌন আচরণই হয়ে ওঠে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিসের প্রভাবে গবেষণা শুরু করেন আলফ্রেড কিনসে । ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে পর পর দুটি গবেষণা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেন। প্রথমটি পুরুষের যৌন আচরণের ওপর, অন্যটি নারীর যৌন আচরণ বিষয়ে।
আলফ্রেড কিনসে ছিলেন একজন আমেরিকান মানসিক বিশেষজ্ঞ। তার অক্লান্ত গবেষণায় বেড়িয়ে আসে মানুষের স্বাভাবিক অস্বাভাবিক সব ধরনের যৌন আচরণের প্রকৃতি ও প্রকারভেদ। এরপর গবেষণায় এগিয়ে আসেন একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ উলিয়াম মাস্টার এবং একজন মনোবিজ্ঞানী ভার্জনিয়া জনসন। তারা উভয়ে একত্রে গবেষণা করেন। তারা মানুষের স্বাভাবিক যৌন আচরণকে পর্যবেক্ষণ করে মানুষের স্বভাবিক যৌন প্রতিক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করেন। তাদের সেই গবেষণা যৌনবিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটায়।
গবেষণার সময়টা ছিল ইউরোপে যৌন বিপ্লবের সময়। নারীরা তখন যৌন ব্যাপারে সচেতন এবং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরুষের মতো তারাও স্বাবলম্বী। শুধু পুরুষের সুখের জন্য নয়, নিজেদের প্রয়োজনে তারা যৌন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং মিলিত হতে চায়। তাই নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌন প্রতিক্রিয়া জানাটা তখন চিকিৎসার কাজে লাগতে শুরু করে। আর তখন থেকেই সেক্স থেরাপির প্রচলন শুরু হয়।
আর এভাবেই মনোবিজ্ঞানী ,মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মানুষের স্বভাবিক যৌন আচরণের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। শরীরের সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পর একজন পুরুষের বা একজন নারীর যে যৌন ব্যর্থতা বা পারফরমেন্সের ঘাটতি তা ঠিক করার দায়িত্বটা মানসিক বিশেষজ্ঞের কাঁধে চলে আসে।
তাহলে কোন ধরনের যৌন সমস্যা নিয়ে আপনি মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন? একদম সাদামাটা বাংলায় যদি বলি তাহলে বলা যায় যৌনভীতি, যৌন অনিহা, যৌন অজ্ঞতা জনিত দুশ্চিন্তা অথবা পারফরমেন্স আশানুরূপ না হওয়া ইতাদি।
আবার অনেক সময় দেখা যায় শারীরিক অথবা মানসিক কোথাও কোনো সমস্যা নেই। মানসিক বলতে যৌনভীতি বা অনিহা কোনটিই নেই, পারফরমেন্সও ভালো কিন্তু দুজনের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কে একটা ফাঁক আছে। ভাঙাচোরা একটা সম্পর্ককে দুজনে কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছেন। এ ধরনের সম্পর্ক যত পুরাতন হয় ঘনিষ্ঠতা না বেড়ে সময়ের সাথে সাথে শুধু তিক্ততাই বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে যৌন সমস্যা না থাকলেও পরবর্তীতে এসে তা দেখা দেয়। আগ্রহ কমে যায়। এই ধরনের সমস্যাতেও মানসিক বিশেষজ্ঞ যথেষ্ট সহায়তা করবে আপনাকে। কাজেই হতাশ না হয়ে আশায় বুক বাধুন।
চলবে…
ডা. এসএম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌন জীবন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অন্যান্য পর্ব গুল পরতে পারেন এখান থেকে
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ১
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ২
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌন জীবন-পর্ব ৪
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।