মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
বাসে জানালার পাশে বসে বেশ একটা ঝিমুনি আসছিল লিরার। পাশে মায়ের কোলে তিন বছর বয়সী তার খুব চটপটে একজন কন্যাসন্তান, অপার কৌতূহলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে তার মাকে। মাঝে মাঝে প্রশ্নগুলো লিরার দিকেও আসছে। শুরুতে একটু তাকিয়ে হেসে পরিচয় জমানোর চেষ্টাটা ভালোই কাজে এসেছে-এই ভেবে ভালোই লাগছিল লিরার। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা মন্দ কাটবে না এই পিচ্চির সাথে আলাপচারিতায়।
হঠাৎই এই সুখের চিন্তায় ছেদ পড়ল, প্রচণ্ড গতিতে পাশের একটা বাস কোনাকুনিভাবে ধাক্কা মেরে চলে গেল, জানালার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল লিরার পাশ দিয়ে। তার একপাশের গালে কাচ লেগে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। এর ভেতরেই লিরা আর বাচ্চার মায়ের হাত বাচ্চাটাকে ঘিরে রেখেছে, মায়ের মুখ ফ্যাকাসে, বাচ্চাটা প্রচণ্ড চিৎকার করে কাদছে। সামনের দিকে আরো অনেকজন আহত হয়েছে। প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর সবাই সচেতন হতে থাকল নিজেদের নিয়ে। লিরাকে সহ বাচ্চাটি আর তার মা বাস থেকে নেমে গেলেন। পাশের একটা ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে গেল সবাই।
শারীরিক আঘাত কয়েকদিন পর সেরে গেলেও এই ঘটনাটা লিরাকে বেশ একটা নাড়া দিয়ে গেছে। তবে লিরার চেয়ে বাচ্চার মা বেশি ভয় পেয়েছিলেন । বাচ্চা বা উনার কোনো আঘাত না লাগলেও থরথর করে কাঁপছিলেন। লিরা ড্রেসিং হতে হতে মায়ের সাথে কথা বলে যাচ্ছিল। ড্রেসিং শেষ হতে একসাথেই গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আরেকটা বাসে ওঠে তারা।
সেখানে পুরোটা সময় মা আর বাচ্চা চুপ করে থমথমে মুখে থাকলেও লিরা জোর করে কথা বলানোর আর চেষ্টা করেনি, তার মনে হচ্ছিল ওরা নিজে থেকে বললে সে শুনবে কিন্তু চাপাচাপি করার দরকার নাই। গন্তব্যে এসে সেই মা অবশ্য বেশ খানিকটা নির্ভার হলেন। লিরাকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। তখন কথাবার্তা হলো ভালোভাবেই। বাচ্চাটিও অনেকটা সহজ হলো।
২. বড়ো একটা বস্তিতে আগুন নিভিয়ে মাত্রই বসেছেন আশফাক। তিন মাসের মাথাতেই অন্তত পাঁচটা বড়ো বড়ো আগুন লাগার ঘটনায় তার ডিউটি ছিল। তাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল ক্যামেরা আর মাইক হাতে দুইজন। তাড়াতাড়ি উঠে পালালেন আশফাক।
এখন তার কোনো ইচ্ছা নেই এদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার। তার দরকার খাবার-পানি আর বিশ্রাম, এদের সাথে আগেও একবার কথা বলেছিলেন, চাপাচাপি করে শুধু বর্ণনা চায়, দুইটাকার বিস্কুটও খাওয়ায় না। বিরক্তি আরো বাড়ে, মাথাটা মনে হয় ফুটতে থাকে।
এতক্ষণে পাঠক আপনারা ভাবছেন, এসব ঘটনা আর প্রতিক্রিয়া কেন দিয়ে যাচ্ছি? একটু চিন্তা করুন তো যদি আপনার বাসায় কারো মাছ কাটতে গিয়ে ধারালো কিছুতে হাত কেটে যায় আপনি কী করেন? তার রক্ত দ্রুত মুছে দিয়ে জীবানুনাশক মলম দেন, ব্যান্ডেজ লাগলে সেটা দেন, ধনুষ্টংকারের টিকা দেয়া লাগবে কিনা সেটা দেখেন, রক্ত পড়া বন্ধ না হলে তুলা চেপে রাখেন, খোঁজ নেন কীভাবে বন্ধ করা যাবে, অনেক সময় ডিসপেন্সারি/হাসপাতালে নেন।
এসব না করে যদি ‘কীভাবে কাটল’, ‘কেন কাটল’, ‘সাবধান হতে পারল না’, ‘আরো কাটতে পারত’ এরকম বকবকানি চলতে থাকে তাহলে কেমন হবে বিষয়টা! এখানেও মলম, ব্যান্ডেজ, টিকা যেমন প্রাথমিক চিকিৎসা বা ‘ফার্স্ট এইড’ সেরকম মানসিক আঘাতেও ‘ফার্স্ট এইড’ বা প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। সেইটা নিয়েই এই লেখায় আলোচনা করব।
মানুষের জীবনে দুর্ঘটনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় বড়ো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা, মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা (এটা হতে পারে বড়ো ধরনের এবং ব্যক্তিগত) এবং দৈনন্দিন চাপ। বড়ো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা যেমন : ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা এগুলো কেটে যাওয়ার পর আক্রান্তরা তুলনামূলকভাবে বরং অনেকটাই স্থির থাকে। কারণ ‘যা ঘটে গেছে তা পেছনে রেখে এখন নতুন করে শুরু করা যাবে’ এই মনোভাব নিয়ে এগোতে পারে। আর একসঙ্গে অনেককে সাথে পায় যারা একই দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। নিজেদের মধ্যে তাই একটা মানসিক বোঝাপড়া হয়ে যায়।
মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা যেমন-হত্যা, গণহত্যা, সন্ত্রাসবাদী হামলা, যুদ্ধ, যৌন নির্যাতন, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, হানাহানি-মারামারি এগুলোতে মানুষের মানসিক আঘাত হয় বেশি; অনিশ্চয়তা-উদ্বিগ্নতা কাজ করে বেশি, আক্রান্ত ব্যক্তি-দল-জাতির নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতে থাকে।
এইসব ক্ষেত্রে শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিক ধাক্কা থাকে উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার হামলায় ৩০০০ মানুষ নিহত হন, সেখানে ৭৫০০ জন মানুষ চিকিৎসা সহায়তা নেন এবং দেখা যায় সারা বিশ্বের মানুষের জন্য এই ঘটনা একটা মানসিক আঘাত হিসেবে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই ধরনের ঘটনা শুধু সংখ্যার হিসেবে নয়, ভৌগোলিক স্থান সময়কালের বিস্তারে মানসিক জগতে ছাপ রাখে। যেই ছাপ ব্যক্তির জীবনে ভয়াবহ রূপেও আসতে পারে। আর তাই এ সময়ে প্রয়োজন যথাযথ মানসিক পরিচর্যা।
কারা দেবেন
এই ধরনের ঘটনায় আক্রান্তদের কাছে যিনি থাকবেন; হতে পারেন পেশাদার কেউ যেমন দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা পেশাদার যেমন পুলিশ, অগ্নিনির্বাপক, চিকিৎসক, প্যারামেডিক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত কেউ, গণমাধ্যমকর্মী : হতে পারেন অপেশাদার কেউ। এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবীয় গুণাবলী।
দুর্ঘটনায় আক্রান্ত একজন মানুষের শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিক জগতে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সেই ক্ষেত্রে চাহিদা থাকে চারটি বিষয়ের :
• নিজের অভিজ্ঞতা কাউকে বলা • সত্যিকারভাবেই কেউ শুনবে তার কথা • যত্ন • এবং সাহচর্য
আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের জন্য যে প্রাথমিক মানসিক পরিচর্যার পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে মূলনীতি হচ্ছে ‘দেখুন-মন দিয়ে শুনুন-যোগাযোগ করিয়ে দিন’ (লুক-লিসেন-লিংক)
তাই যখনই কাউকে কোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত অবস্থায় পেলেন তখন এই তিনটা বিষয় খেয়াল রেখে এগোন।
• দেখুন : তার এখন কী প্রয়োজন
পানি/খাবার/কাপড়/ওষুধ/আশ্রয়/আইনগত সাহায্য/টাকা/তথ্য। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো দিয়ে তাকে সাহায্য করুন। কোথায় কার কাছে পাওয়া যাবে, কীভাবে তার জন্য ব্যবস্থা করা যায় সেই চেষ্টা করুন।
• শুনুন : সে কী বলতে চায়
তার অভিজ্ঞতা শুনুন, তবে চাপাচাপি করে না। জোর করে ঘটনা বা অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতে চাইলে সেটা আরো মানসিকভাবে ক্ষতি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘটনার বর্ণনা মানুষটাকে এবং তার কষ্ট ছাপিয়ে চটকদার হয়ে উঠছে; এসব ক্ষেত্রে বরং তাকে চুপ থাকতে দেয়াই মানসিক পরিচর্যার অংশ। ইদানীং গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায় কোনোরকমের দুর্ঘটনার পর অদ্ভুত একটা প্রতিযোগিতা বিশ্লেষণের। যে বা যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের গোপনীয়তা, আত্মমর্যাদাকে সম্মান করা প্রয়োজন ।
• যোগাযোগ করিয়ে দিন
আহতের নিজের পরিবার/আত্মীয়/পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া/তাদের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও মানসিক পরিচর্যার অংশ। বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা খুব প্রয়োজন ।
একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে কাউকে দুর্ঘটনার পর সাহায্য করতে গিয়ে নিজের সেই ক্ষমতাও যাচাই করে রাখা দরকার। কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে আরো মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারেন যদি কথা বলার জন্য চাপাচাপি করেন, ব্যক্তিগত/ দলগত কোনো স্বার্থ উদ্ধারের বিষয় থাকে। এরকম ক্ষেত্রে নিজে নিস্পৃহ থেকে বরং পেশাদারদের কাছে আক্রান্তদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
যা করবেন না
• আক্রান্তকে দোষারোপ। ’তোমার কারণেই হয়েছে’। এই মন্তব্য করা আরো আঘাতের হয়। সুতরাং আহত ব্যক্তিকে এ ধরণের কথা না বলা।
• শোকাহতকে নিজের বেঁচে যাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ হতে বলা। কেননা, আপনি জানেন না হয়তো নিজের এই বেঁচে যাওয়াটাই তার গভীর অপরাধবোধের কারণ।
• শিশুদের সামনে দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দোষারোপ করা।
• আপনি নিজে এর চেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা হেসেখেলে পার হয়ে এসেছেন এমন বর্ণনা দেয়া। দুর্ঘটনার স্থান বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের ছবি তোলা বা ভিডিও করার চেয়ে তাৎক্ষণিক সহায়তাটা জরুরি। কাজেই আগে বাস্তব সহয়তা করুন, ছবি কিংবা ভিডিও নয় ।
আবার পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে থেকে ভিড় বাড়ানোর চেয়ে ঘটনাস্থলকে ভিড়মুক্ত রাখা জরুরি। সেক্ষেত্রে দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে অহেতুক ভিড় তৈরি করবেন না। আবারো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই ফার্স্ট এইডের জন্য মানবীয় গুণাবলী খুব গুরুত্বপূর্ণ।
লিখেছেন : ডা. সৃজনী আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক,
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ, মগবাজার
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে
সূত্র : মাসিক মনের খবর এপ্রিল ১৯’ সংখ্যা।
- মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। মনের খবর অনলাইনে লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা হোয়াটসঅ্যাপ 01844618497 নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর