১. নয়নের বয়স সাড়ে ছয় মাস। বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে। এই কাজটি করতে গিয়েই গলদঘর্ম হচ্ছেন মা। ছেলে এটা খাবে না, ওটা মুখে দেবে না। মুখে বলতে না পারলে কী হবে -চেহারার অভিব্যক্তি, শারীরিক অস্থিরতা আর তার স্বর চিৎকারে ঠিকই জানান দেয় নিজের অনীহা। কখনো আদর, কখনো মনোযোগ-বিকর্ষী শব্দ, কখনোবা চোখ পাকিয়ে ছেলেকে চেপে ধরে, মুখের মধ্যে খাবার ঠুসে দেন মা।
২. চার বছরের রিমি ঘরময় দাপিয়ে বেড়ায়। এক দণ্ড-স্থির হয়ে বসতে চায় না কোথাও। হাতে-খড়ির জন্য নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্লে-গ্রুপে ভর্তি করা হয়েছে ওকে। সেখানে যদিওবা কিছুক্ষণ শান্তভাবে বসানো যায় তাকে, বাসায় দুরন্তপনা চলতেই থাকে। ঘরে তাকে পড়তে বসাতেই পারেন না বাবা-মা। এক অক্ষরও পড়তে লিখতে চায় না সে বাসায়। পড়ানো তো দূরের কথা, শান্তভাবে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা, খাওয়ানোও যেন বাবা-মায়ের জন্য এক লড়াই।
৩. আট বছরের আপন সারাক্ষণ পড়ে থাকে মোবাইল ফোন আর ট্যাব নিয়ে। কার্টুন দেখে, গেইমস খেলে। খাওয়ার সময়টাতেও হাত ছাড়া করে না গেজেট। কোনো না কোনো অজুহাতে স্কুলে অনিয়মিত। বাসায়ও গৃহশিক্ষকের কাছে গরহাজির। বাবা-মা হাত থেকে ফোন বা ট্যাব সরিয়ে নিলেই শুরু হয় ছেলের রাগারাগি। এমনকি কখনো-সখনো বাবা-মার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না সে।
৪. ক্লাস নাইনে নতুন স্কুলে ভর্তি হলো রাশেদ। কিছুদিন পর থেকেই তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন টের পান বাবা-মা। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে দেরি করে আজকাল, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘোরা-ফেরা, আড্ডা দিতেই আগ্রহ বেশি। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ওর ঘরে বাবা-মায়ের ঢোকাটা যে অপছন্দ করে তা বুঝিয়ে দেয় প্রকাশ্যেই। খাবার টেবিলে বাবা-মা পান না ওকে। অনেক রাত পর্যন্ত রাশেদের ঘরে আলো জ্বলে। টাকার চাহিদাও বাড়তে থাকে। বাবা-মা খরচের খাত জানতে চাইলে আচরণ রুক্ষ হয়ে ওঠে ছেলের।
৫. জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি-এইচএসসি সাফল্যের সঙ্গে পাস করেছে নাবিলা। ভালো ছাত্রী, লক্ষ্মী মেয়ে বলে আত্মীয়-বন্ধু মহলে পরিচিত মেয়েটির বাবা-মার সঙ্গে বিরোধের শুরু হয় এইচএসসির পরই। বাবা-মা চান মেয়ে মেডিক্যালে পড়বে, বংশে প্রথম ডাক্তার হবে। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার। বাবা সাফ জানিয়ে দেন, ঐ বিষয় পড়লে তার পড়ার খরচ তিনি দেবেন না। আত্মীয়রা বাবা-মার পক্ষ নিয়ে বোঝাতে আসে নাবিলাকে। কেউ কেউ অবশ্য নাবিলার পক্ষ হয়ে বোঝাতে যায় বাবা-মাকে।
৬. ইন্টার্ন শেষে যখন উচ্চতর শিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে লাবিব, মায়ের বান্ধবীর মেডিক্যাল-পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয় পরিবারে। এ ব্যাপারে লাবিবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মা জানতে পারেন, তিন বছর ধরে তার প্রেমের সম্পর্কে রয়েছে এবং যাকে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করবে বলে তার স্থির সিদ্ধান্ত। এদিকে মা কথা দিয়ে রেখেছেন তার ছোটবেলার বান্ধবীকে, বান্ধবীর মেয়েকেই বউ করে নিজের ঘরে আনবেন তিনি।
৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স শেষ করার পর আফরিনকে বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিতে বলেন বাবা-মা। পাশাপাশি চলতে থাকে তার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ। আফরিন সাফ জানিয়ে দেয়, বিয়ের পরিকল্পনা আপাতত তার নেই। বিসিএস-এরও না। জাপান আর অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি স্কলারশিপের চেষ্টা করছে সে। পড়াশোনা শেষে বিদেশেই থিতু হওয়া লক্ষ্য তার।
৮. বিয়ের পাঁচ বছর পর সাদাত বাবা-মাকে জানায়, সে আর এই সম্পর্কটা বয়ে নিতে পারছে না। বিষাক্ত হয়ে ওঠা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে আইনগতভাবে বিচ্ছেদের পরিকল্পনা করছে সে। ছেলের পরিকল্পনা শুনে শঙ্কিত বাবা-মা। তাদের বংশে ডিভোর্সের কোনো ইতিহাস নেই। ছেলে বউকে তালাক দেবে, এই ব্যাপারটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা।
৯. হুট করেই চাকুরিটা চলে যায় তাপসের। কারো অধীন চাকুরি না করে এখন থেকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করবে বলে মনস্থির করে সে। কিন্তু যথেষ্ট পুঁজি তার হাতে নেই। প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাতে বাবার কাছে সম্পত্তি ভাগ করার প্রস্তাব তোলে ছেলে। বাবার জীবদ্দশায় সন্তান সম্পত্তি ভাগের কথা তোলায় ব্যথিত হন বাবা। মা-ও রাগ করে ছেলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। সম্পত্তি ভাগের জন্য বাবা-মাকে চাপ দিতে ভাই-বোনকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে তাপস।
১০. স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রাম থেকে এসে শহরে একমাত্র মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন আয়েশা আক্তার। চার দেয়ালের ভেতর দিন-রাত, হাঁপিয়ে ওঠে মন। আশেপাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করতে যাওয়া পছন্দ করে না মেয়ে। কাজের লোকদের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলা যায় না। পাঁচ বছর বয়সী নাতনিটাকেও কেমন যেন তার থেকে দূরে দূরেই রাখে মেয়ে, বুঝতে পারেন আয়েশা।
উদাহরণগুলোকে খুব একটা বিরল বলা যাবে না। তাই বলে কি পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক জীবনব্যাপী কেবলই বিরোধপূর্ণ? মোটেও তা নয়। জগতের সকল সম্পর্কের ভেতর সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্কই সবচেয়ে প্রাথমিক, সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে সংযুক্ত, মিথস্ক্রিয়ায় সবচেয়ে সক্রিয় ও গতিশীল। এ কারণে ভালোবাসা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আস্থা আর বিশ্বাসের চর্চার সুযোগ যেমন এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি, তেমনি বিরোধ, দ্বন্দ্ব বা মতানৈক্যও অবশ্যম্ভাবী। ওপরের উদাহরণগুলোর মতো জীবনের যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে বিপরীতমুখী অবস্থান তৈরি হতে পারে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের।
জীবন চলার পথে এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। এসবের মধ্য দিয়েই সম্পর্ক এগিয়ে যায়। মানুষ বেড়ে ওঠে। শেখে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পারস্পরিক সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ছাড় দেয়ার মানসিকতা, আত্ম-নির্ভরশীলতা। পারিবারিক পরিমণ্ডলের এ শিক্ষাই ব্যক্তির সামাজিক জীবনে পথ চলার ভিত্তি। সে-কারণে সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার যেকোনো বিরোধ বা মতানৈক্যই নেতিবাচক নয়। দ্বন্দ্ব মানেই সম্পর্কের ইতি নয়, দ্বন্দ্ব মানেই থমকে যাওয়া নয়। প্রতিটি বিরোধ বা দ্বন্দ্বই পিতা-মাতা ও সন্তান সবার জন্যই শিক্ষার, অভিজ্ঞতার, বিকাশের সুযোগ। এই দ্বন্দ্বকে একটি সমস্যা মাত্র ধরে নিয়ে এর সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টাই জীবনকে এগোবার পথ করে দেয়।
অধিকাংশ পরিবারেই এ ধরনের পরিস্থিতি ক্ষণস্থায়ী হয়, গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে এসে অটুট থাকে পারিবারিক বন্ধন। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই বিরোধের মীমাংসায় পিতা, মাতা বা সন্তানের ভুল পদক্ষেপ বা সঠিক সিদ্ধান্তের ব্যর্থতায় পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, বিছিন্ন হয়ে যায় শারীরিক বা মানসিকভাবে। ভুক্তভোগী হতে হয় শেষ পর্যন্ত পরিবারের সকল সদস্যকেই। জীবনের বাঁকে বাঁকে এ ধরনের দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, এ ব্যাপারে বয়সী হিসেবে অগ্রিম ধারণা থাকা প্রয়োজন পিতা-মাতারই এবং এ ধরনের পরিস্থিতির সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্তানের বয়স অনুয়ায়ী তাকেও কিছুটা প্রস্তুত করে রাখা ভালো। সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে, সে ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি থাকলে বিরোধপূর্ণ অবস্থা ক্ষণস্থায়ী হওয়ার এবং দ্রুত একটা সমাধানে পৌঁছার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এজন্য বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটিকে প্রভু-ভৃত্য, আজ্ঞাকারী-আজ্ঞানুবর্তী, কিংবা চাহিদা দাতা পূরণকারীর না হয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর আস্থার হওয়া দরকার।
যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে যেন পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ থাকে। নির্ভয়ে যৌক্তিক অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। একজনের অভিমত বিনা মূল্যায়নে উপেক্ষা করার মনোভাব যেন গড়ে না ওঠে কারো ভেতরেই। পারিবারিক বন্ধনের স্বার্থে যৌক্তিক ছাড় দেয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার চর্চা যেমন করাতে হবে, তেমনি স্বাধীন চিন্তার ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বেড়ে ওঠার সুযোগও দিতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের ভিত্তিতে সকল বিরোধ-দ্বন্দ্ব-মতানৈক্যের যথাযথ, সর্বসম্মত ও যৌক্তিক সমাধানের মাধ্যমেই সুখী একটি পরিবার এগিয়ে চলে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে।
ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে