সবাই আমরা স্বাধীন হতে চাই। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে চাই, কাজ করতে চাই। আর এ কারণেই ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে মনে পড়ে যায় কত সংগ্রাম, কত আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। প্রশ্ন জাগে, কী এই স্বাধীনতা? সহজ ভাষায়, নিজের মনের মতো করে কোনো রকম বাঁধা ছাড়া নিজের মত প্রকাশ করতে পারা, চলাফেরা করা, সিদ্ধান্ত নিতে পারা এবং দক্ষতাকে ব্যবহার করতে পারার নাম স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা অবশ্যই একটি ইতিবাচক শব্দ যার দ্বারা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যের কোনো ক্ষতি না করে। এই স্বাধীনতার কি কোনো সীমা থাকা উচিত? স্বাধীনতা যতক্ষণ আমার আত্ম-উন্নয়ন, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ততক্ষণ এর কোনো সীমা নির্ধারণ অবাঞ্ছনীয়।
তবে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দুটো বিষয় এক নয়। যখন ব্যক্তি যা ইচ্ছা তাই করে এবং এর কারণে সমাজে বিশঙ্খলা সৃষ্টি হয়, অন্যের অধিকার হরণ করা হয়, অন্যকে বিপদে বা অসুবিধায় ফেলা হয়। উপরন্তু যে স্বাধীনতা পক্ষান্তরে ব্যক্তির জন্য বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই হলো স্বেচ্ছাচারিতা। আর এই স্বেচ্ছাচারিতাকেই আমরা কখনো কখনো স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করি।
যেমন ধরা যাক, একটি মেয়ে লেখাপড়া করতে চায়, ঘরের বাইরে কাজ করতে চায়। তার এই ইচ্ছা বা চাওয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত উন্নয়ন, তার সামাজিক উন্নয়ন জড়িত এবং এতে অন্য কোনো ব্যক্তির কোনো প্রকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই নগণ্য। তাই পড়তে চাওয়ার স্বাধীনতা তার আছে। এমন যদি হয় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েটি রাত বারোটার পর একা রাস্তায় চলাচল করতে চায়, যদিও তার চলাফেরার স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এই চলাচলের কারণে সে যেকোনো সময় বিপদের মুখে পড়তে পারে জেনেও যদি সে এই কাজ করতে চায় সেটাই হবে স্বেচ্ছাচারিতা।
আর এসব কথা চিন্তা করে কখনো কখনো ব্যক্তির নিরাপত্তা, কখনো বা সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা ভেবে পরিবার বা সমাজনিয়ন্ত্রক বা রাষ্ট্র স্বাধীনতার সীমা টানতে চায়। যেমন ধরা যাক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সবারই আছে।
আমার সিদ্ধান্ত, আমার পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা, খারাপ লাগার প্রকাশ করা, মতামত প্রদান করার ইচ্ছা থাকতেই পারে এবং তা আমরা অবশ্যই বাস্তবায়ন করব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা অন্যকে গালি দেব, অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করব, কাউকে হেয় বা নিচু করার চেষ্টা করব।
আর যখনই এই দুটো বিষয়ের মধ্যে আমি সীমা টানতে পারব না, তখনই হবে সেটা স্বেচ্ছাচারিতা। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করাও স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর মাত্র। আমার ক্ষমতা থাকলেই আমি যা ইচ্ছা তা করতে পারি না আর এটাই স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন। প্রতিটি পরিবার, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র যদি এই বিষয়টি অনুধাবন করে তবে আমরা পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে স্বাচ্ছন্দ্যে, নিরাপদে থাকতে পারব।
স্বেচ্ছাচারিতা রোধের জন্য প্রতিটি পরিবারের কিছু নিয়ম থাকে, ধর্মীয় কিছু অনুশাসন থাকে, সমাজের কিছু নিয়মনীতি থাকে, রাষ্ট্রীয় কিছু বাধ্য-বাধকতা থাকে। অনেকের কাছে সেটার নামান্তর হতে পারে স্বাধীনতার সীমা টানা।
আমরা যদি পাশ্চাত্যের দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, অর্থনৈতিকভাবে তারা অনেক উন্নত হলেও সামাজিক বিরোধ, ব্যক্তিগত সমস্যা, ডিভোর্স, পারিবারিক বিরোধ এই বিষয়গুলো তুলনামূলকভাবে সেখানে বেশি।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্কুল ছেড়ে দেয়া, মাদকের ব্যবহার, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার হার দিন দিন বেড়েই চলছে। এর কারণ যদি আমরা তলিয়ে দেখি তা হচ্ছে, অত্যধিক স্বাধীন জীবন-যাপনে বিশ্বাস এবং স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণে অপারগতা।
তারা স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সীমা বুঝতে অপারগ। তাই এই বিষয়টি খুবই জরুরি যে আমাদের পরিবার, সমাজ এগিয়ে আসুক ব্যক্তির সত্যিকার স্বাধীনতা উপভোগে সাহায্য করতে এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে সচেতন হতে ও করতে।
সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহিদ
সহকারী অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি)
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে