ব্যক্তি স্বাধীনতা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়াতে পারে

ডা. মুনতাসীর মারুফ

করোনাকালে মাস্কে মুখ ঢেকে রাখতে আপত্তি কেবল আমাদের দেশের স্বাধীনচেতা মানুষেরই নয়। সারা বিশ্বেই নানা দেশে, নানা স্থানে মাস্কের প্রতি স্বাধীনচেতা মানুষের অনীহা দৃশ্যমান।

কেবল অনীহা বললে বরং ভুলই হবে, ব্যানার-ফেস্টুনসহ রীতিমতো প্রতিবাদ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘটও হয়েছে মাস্ক পরার নির্দেশের বিরুদ্ধে। কেবল বিদেশ-ফেরত বাংলাদেশিরাই বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের বিরুদ্ধে ইংরেজি ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের সিস্টেমর ফাঁক-ফোকর খুঁজতে চাননি, মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে থেকেও উন্নত দেশের কিছু মানুষও কোয়ারান্টাইনের বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করেছেন এবং করছেন।

এ ধরনের মাস্ক-কোয়ারেন্টাইনবিরোধী বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে মূলত আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, উতাহসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মাস্ক-বিরোধী সমাবেশের খবর এসেছে সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ইংল্যান্ডে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে, স্পেনে মাদ্রিদের প্লাজা কোলোনে হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ। স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে, ইটালির রোমে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনিতে মাস্ক-বিরোধী জমায়েত হয়েছে সেপ্টেম্বরেও। কোনো কোনো র‌্যালিতে জমায়েত ছিল হাজারো মানুষ। প্রতিবাদী মানুষের সঙ্গে মাস্কের পক্ষের লোক আর পুলিশের সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে। মাস্ক আর

কোয়ারেন্টাইন বিরোধিতায় যুক্তি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষা, স্বাধীন চেতনা রক্ষা। প্রতিবাদ সমাবেশে ব্যবহৃত ব্যানার-ফেস্টুনের কিছু স্লোগানের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়Ñব্যক্তিগত স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয়, স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক, আমরা স্বাধীনতা চাই ইত্যাদি।

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সাইকিয়াট্রিস্ট স্টিভেন টেইলর এবং ইউনিভার্সিটি অব রেগিনার সাইকোলজিস্ট গর্ডন এসমুন্ডসনের যৌথ প্রয়াসের গবেষণা প্রবন্ধটিতেও মাস্ক বিরোধিতার পেছনে মানুষের স্বাধীনচেতা মনোভাবের বিষয়টিই উঠে এসেছে।

আমেরিকা ও কানাডার জনগোষ্ঠীর ওপর তারা জরিপ করে দেখতে পান, ৮৪ শতাংশ মানুষই মাস্ক ব্যবহার করেছেন। এর বিপরীতে যে ১৬ শতাংশ মাস্ক ব্যবহার করেননি, তাদের এই মাস্ক-বিরোধী মনোভাবের কারণ নিয়েই ছিল গবেষণা। প্লস ওয়ান জার্নালে ২০২১ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি তাদের গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

মানুষ স্বভাবত স্বাধীনচেতা। অথবা তারা নিজেদেরকে স্বাধীনচেতা ভাবতে বা সেই হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ বা বিধিনিষেধ মানতে তার আপত্তি। যা ইচ্ছা তা-ই করব, কেউ বাধা দেবে না কোনো কাজেই এরকমটাই সুপ্ত বাসনা। রাষ্ট্রের-সমাজের শাসন, রীতি তাদের স্বাধীনসত্তাকে আহত করে।

মাস্ক-বিরোধীদের যুক্তি, শরীরের মতোই মুখ ঢাকবেন কি ঢাকবেন না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল ব্যক্তির নিজের। এ ব্যাপারে জোর করা, নির্দেশ দেয়া বা আইন করে বাধ্য করা তার স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল। তেমনিভাবে,

কোয়ারেন্টাইন মানে চলাফেরার স্বাধীনতায় বাধা প্রদান। করোনায় মরতে হলে মরবেন, তবু নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাব বিসর্জন দিয়ে অন্যের সমাজ বা রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া কোনো সিদ্ধান্ত তারা মানবেন না।

স্বাধীনচেতা ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আর সমষ্টির স্বার্থ, নিরাপত্তা বা সুস্থতার সঙ্গে এই যে দ্বন্দ্ব, এটি কিন্তু নতুন কিছু নয়। সেই ১৯১৮-২০ এর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা স্প্যানিশ ফ্লুপ্যানডেমিকের সময়েও গড়ে উঠেছিল Anti-Mask League of San Francisco নামের সংগঠনটি। ১৯১৮-এর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম রোগী শনাক্ত হন সানফ্রান্সিসকোতে, অক্টোবরের মাঝামাঝি হতেই ২০০০-এর বেশি আক্রান্ত হন।

শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখভাল করা সংস্থাটি রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে নানা ব্যবস্থা নেন। সমাবেশ-জমায়েত নিষিদ্ধ হয়, স্কুল আর নাট্যশালা বন্ধ হয়, ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয় নাগরিকদের। নির্দিষ্ট কিছুর পেশার মানুষকে মাস্ক পরতে নির্দেশ দেয়া হয়। অক্টোবরের ২৫ তারিখে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সকলকে মাস্ক পরার বাধ্য-বাধ্যকতার অধীনে আনা হয়।

প্রতিবাদের মুখে এক মাসের কম সময়ে অধ্যাদেশ বাতিলের পর ১৯১৯ এর জানুয়ারিতে আবার রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারো অধ্যাদেশের মাধ্যমে মাস্ক পরার নির্দেশ জারি হয়। সে সময় এ ধরনের অধ্যাদেশ ‘Civil rights’ ক্ষুণ্ণ করছে এ দাবি তুলে Anti-Mask League of San Francisco এর মাস্ক-বিরোধী জমায়েত ও অন্যান্য কার্যক্রম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

শুধু মহামারি ক্রান্তিকালেই নয়, এর আগে-পরেও নানা সময়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আরোপিত নিয়ম-কানুনের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিতর্ক চলতে থাকে। বিশেষত ছোঁয়াচে, সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে মানুষের নানাবিধ স্বাধীনতাকে সীমিত করার পরামর্শ আসে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে সমষ্টির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়।

যক্ষ্মা-আক্রান্ত রোগীর কথাই ধরি। যক্ষ্মা-আক্রান্ত ব্যক্তি যদি মনে করেন, তিনি স্বাধীনচেতা। সুতরাং তিনি কোনো চিকিৎসা গ্রহণ করবেন না এবং সমাজের সকলের সঙ্গে আগের মতোই অবাধে মিশতে থাকবেন, সেক্ষেত্রে যক্ষ্মা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে। তাতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মূল্য যেমন তার নিজেকে দিতে হবে, তেমনি তার মূল্য চুকাতে জীবন দিতে হতে পারে পরিবার বা প্রতিবেশীকেও।

আবার যক্ষ্মা-আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছে মতো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করেন বা কিছু দিন ওষুধ সেবন করে বাদ দেন। পরবর্তীতে মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট এবং এক্সটেন্ডেড স্পেক্ট্রাম রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই স্লোগানটি ফিরে আসবে। সেটি জানা সত্ত্বেও কি আমরা এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেব, নাকি সমাজের সামগ্রিক স্বাস্থ্য-নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেব?

অপ্রয়োজনে বা ইচ্ছে মতো অ্যান্টিবায়োটিক সেবন বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে অর্ধেক কোর্স অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ব্যক্তির স্বাধীনতা পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ বাড়াবে, যার মূল্য দিতে হবে সমাজ তথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে।

ধূমপান একজন ব্যক্তি করবেন, কি করবেন না এটি কি তার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত? ধূমপানে ব্যক্তির ফুসফুসের ক্ষতি হয়, ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় এ তথ্যটি জেনেও ব্যক্তি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় যদি ধূমপান করতে চান, নিজের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ান, তাতে সমাজ বা রাষ্ট্র বা অন্য কারো কিছু বলার কোনো অধিকার নেই। আসলেই কি তা-ই?

ধূমপানে ব্যক্তি কেবল নিজের ক্ষতি করছেন না, তার আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন, পরিবেশে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন, যার নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে সমাজের অধূমপায়ী ব্যক্তিকেও।

জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এমন অনেক উদাহরণ টানা যায়, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা বা স্বাধীন-চেতনাকে সমুন্নত রাখার মানে দাঁড়ায় সমষ্টির স্বাস্থ্য-ঝুঁকি। ব্যক্তির জীবনাচরণের যেসব বিষয় সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে, অন্যের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে সেসব আচরণে বিধিনিষেধ আরোপ করা সমষ্টির স্বার্থেই জরুরি। করোনাকাল আবারো আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।

ডা. মুনতাসীর মারুফ

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleকরোনার হানা পাবনা মানসিক হাসপাতালে, আক্রান্ত ২২
Next articleভীতি ও মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে সফলতা লাভের উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here