করোনাভাইরাস বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যেও সংক্রামিত হচ্ছে এবং তা শিশুদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে বাদ যায়নি বিশেষ শিশুরাও।
করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে দূরে রাখার জন্য স্বাভাবিক শিশুদের পাশাপাশি বিশেষ শিশুদেরও একটি রুটিন করুন। তাদের খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, ঘুম ও শিক্ষাদীক্ষা একটি নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী চলতে অভ্যস্ত করুন।
করোনা উপসর্গ দেখা দিলে করণীয়: বিশেষ শিশুদের করোনার উপসর্গ অন্য শিশুদের মতোই। যেমন: জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। উপসর্গগুলো অন্য শিশুদের মতো হলেও তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তারা নিজেদের পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিজেরা রাখতে পারে না (অন্য শিশুদের তুলনায়)।
করোনার উপসর্গ থাকলে যেমন: হালকা ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বরের জন্য নাপা বা প্যারাসিটামল এবং এন্টি হিসটামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে এবং জ্বরের জন্য গা স্পঞ্জিং করতে হবে। এছাড়াও, গলাব্যথা হলে লবণ ও গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করবে, গরম পানি খাবে, তুলসী পাতার রস খাওয়ানো যেতে পারে।
জ্বর যদি না কমে এবং রোগ বাড়তে থাকে তাহলে বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক বা হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন। তবে শিশুদের হাইপার একটিভিটি ও অন্যান্য এর জন্য নির্ধারিত ওষুধ বন্ধ করার প্রয়োজন নেই।
শিশুর সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা: শিশু বাইরে গেলে মাস্ক পরাবেন, দিনে ৩/৪বার সাবান পানি দিয়ে (নিজে এবং শিশুকে) হাত ধোয়া, গরম পানি খাওয়াবেন কয়েকবার, বাসার খেলনাগুলো সপ্তাহে ২ বার পরিষ্কার করবেন, এ সময় বাড়িতে অতিথি প্রবেশ না করানোই ভালো, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে নিজে বা শিশু যাবে না।
যদি যান- শারীরিক দূরত্ব মানা, মাস্ক ও হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মানা, বাসায় ঢুকার পূর্ব মুহূর্তে এলকোহল যুক্ত হ্যান্ড সেনিটাইজার দ্বারা হাত সেনিটাইজ করুন, হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন, সর্বোপরি গোসল ও কাপড় ধৌঁত করে তারপর আপনার প্রিয় শিশুকে স্পর্শ করুন।
বাড়িতে শিশুর খাবার–দাবার: এ সময় বিশেষ শিশুরা বাড়িতে তাদের পূর্বের স্বাভাবিক খাবার খাবে। তবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ডাল প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খাবে। তাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
সবুজ শাক-সবজি-ফলমূল বেশি খাবে এবং তাদের ভিটামিনস ও মিনারেলযুক্ত খাবার বেশি খেলে তাদের ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। এসময় শিশুদের প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।
এছাড়াও, করোনাভাইরাস নাক ও মুখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রথম ৩-৫ দিন তারা মানুষের গলায় সংক্রমিত হয়। এজন্য দিনে ৩-৫ বার গরম পানি লবণ দিয়ে/লেবু-চা এ সময় বিশেষ শিশুর করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।
বাসায় শিক্ষাদীক্ষা/পড়াশুনা: যে সমস্ত বিশেষ শিশু নিয়মিত স্কুলে যেত, তাদের হঠাৎই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুর আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। আমরা জানি ওরা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থাকতে চায় এবং রুটিন মেনে চলতে চায়। তাই এ সময় শিশুর জন্য বাসায় স্কুল সময়ে একটি সেশনের আয়োজন করুন (১-২ ঘণ্টা)।
সেটি হতে পারে সকালে ১০টা-১২টা বা ৯টা-১১টায়। যেখানে স্কুলের সঙ্গে মিল রেখে শিশুকে বয়স অনুযায়ী ছবি আঁকা শিখান, ছড়া শিখান, গল্প বলুন, ধর্মীয় বিধিবিধান শিখান, গান বা মিউজিক শিখান। এতে শিশু তার বিভিন্ন শিক্ষায় পারদর্শী হবে এবং তার সময়গুলো খুব ভালো কাটবে। স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে এ সময় নিয়মিত পড়াশোনার ব্যাপারে যোগাযোগ রাখুন।
বাড়িতে খেলাধুলা/সময় কাটানো: করোনাকালীন সময়ে এই বিশেষ শিশুদের মধ্যে মানসিকভাবে এক ধরনের বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা কাজ করবে। কারণ তারা অন্যদের সঙ্গে খেলতে পারছে না। তাদের ভাবনাগুলোর আদান-প্রদান করতে পারছে না। যদিও তাদের ভাবের বহিঃপ্রকাশটা অন্যদের মতো নয়, ভাব বিনিময় অন্য শিশুদের তুলনায় আলাদা। তাদের সঙ্গ দিন এবং তাদেরকে সময় দিন এবং বাড়ির ছোট ছোট কাজে নিয়োজিত রাখুন।
সম্ভব হলে বাসায় পাজল দিয়ে খেলা, বাবল ফুলানো খেলা, টুকি খেলা, পুতুল খেলা, চা বানানো খেলা ইত্যাদি খেলাতে নিয়োজিত রাখুন। আর এ সমস্ত খেলাতে পিতা-মাতা উভয়েই আপনার শিশুর সঙ্গে খেলুন এবং শিশুর খেলাকে আরও আনন্দময় করুন।
বাইরের খেলাধুলা: করোনায় এ শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত, তাই করোনার এই সময়ে তাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা মাঠে (যেখানে মানুষ কম) অথবা ছাদে বিকালে খেলাধুলা অথবা হালকা শারীরিক শরীর চর্চার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তাতে শিশুর শরীর ও মনের অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। খোলা মাঠ ও ছাদে নেয়া সম্ভব না হলে, শিশুকে দিনের বেলায় ঘরের বারান্দাতে অথবা জানালার পাশে বসতে উৎসাহিত করুন।
বিশেষ শিশুর ঘুম: আপনার বিশেষ শিশুর ঘুমের প্রতি বিশেষ নজর রাখুন। একটি কথা মনে রাখবেন, রাতের স্বাভাবিক ঘুম, দিনের আনন্দকে বাড়িয়ে দিবে অনেক গুণ। করোনার এ সময়ে শিশুরও মানসিক উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠা থাকে ফলে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। শিশুকে রাতে ৯-১০টার মধ্যে বেডে শোয়ানোর অভ্যাস করুন।
এ সময় মোবাইল ও অন্যান্য ডিভাইস তার রাতের ঘুমের বাধার কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেদিকে খেয়াল করুন, প্রয়োজন হলে তার স্বাভাবিক ঘুমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে মেলাটনিন জাতীয় ওষুধ ১/২ ট্যাবলেট খাওয়াতে পারেন।
শিশুর আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখুন: এ সময়ে বিশেষ শিশুর আচরণের উপর মনোযোগ দিন। শিশুর হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন দেখা গেলে, হঠাৎ অতিমাত্রায় চঞ্চলতা দেখা দিলে (হাইপার একটিভিটি) তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে খেয়াল রাখুন এ সময় শিশু যেন অতিমাত্রায় ডিভাইস নির্ভর না হয়ে পড়ে।
সর্বোপরি, করোনাকালীন অটিজম ও বিশেষ শিশুর প্রতি অধিক নজর রাখুন এবং নিয়মিত এ শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।