মাদকাসক্তি একটি রোগ। আরো স্পষ্ট করে বললে মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ বা মস্তিষ্কের রোগ। মাদক সেবন করলে কি ছুসংখ্যক লোক মাদকাসক্ত হয় (আনু. ১০%)। বাকিরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি বা যারা জেনেটিক্যালি ঝুঁকিপূর্ণ, তারা একবার মাদক সেবন করলে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কার্যত তাদের জিনই পরবর্তীতে মাদক নেয়ার ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাদকে তুষ্ট জিন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদকাসক্তি চালিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘদিন মাদক সেবনে মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ছাড়া ভালো করা অসম্ভব। এছাড়াও মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ২০- ২৫% গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, যা পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই মাদক প্রতিরোধে রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাষ্ট্র অবৈধ নেশাদ্রব্যের সরবরাহ কমানো, বহনকারী বা বিক্রিকারীকে শাস্তির আওতায় আনাসহ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। আমরা এখানে বিশেষ করে একটা পরিবার কীভাবে মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব। মাদকাসক্তির কারণ একজন ব্যক্তির ভেতরেই নিহিত থাকে, আর এরাই মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি। জেনেটিক সমস্যা শতকরা ৪০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য দায়ী। বাকিটা পরিবার, স্কুল, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি মাদক নেবে কি নেবে না তা ১৪ বছর বয়সের আগে শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করে। ১৪ বছরের পর জিন এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ উভয়েই নিয়ন্ত্রণ করে। বয়স যত বাড়তে থাকে, জিন ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় চলে আসে, সেইসঙ্গে পরিবার এবং পারিপার্শ্বিকতার ভ‚মিকা আস্তে আস্তে কমে যায় এবং ৩১ বছরের পর কোনো ভূমিকাই থাকে না। মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তি যতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে জন্মাক না কেন, মাদক না নিলে বা মাদক কী জিনিস তা বুঝতে না পারলে, কোনো ব্যক্তিই মাদকাসক্ত হবে না। তাই কেউ যেন মাদক না খেতে পারে এবং তার জিন যেন মাদক কী বুঝতে না পারে, তার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
শুধু তা-ই নয়, মজার ব্যাপার হলো মাদক নেয়ার আগে, মাদক নেবে কি নেবে না এটাও জিন নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে কি মিশবে না এটাও জিনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এই জিনকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। জিনকে শনাক্ত করে তার খারাপ অংশ ফেলে দেয়া আমাদের পক্ষে বর্তমানে সম্ভব নয়, তবে ভালো খবর হলো বাহ্যিক কিছু আচার- আচরণ এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে জিনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন- সন্তানদের ধর্মীয় অনুশাসনে বড় করতে হবে, যে পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠে ওদের মধ্যে মাদকাসক্তি নেই বললেই চলে। সন্তান পালনে পরিবার এবং বাবা-মায়ের ভূমিকা, মধুর পারিবারিক পরিবেশ, ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, পড়াশোনায় অগ্রগতি- শুধু সসন্তান হতেই সহায়তা করে না, জেনেটিক ঝকি কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, বৈবাহিক জীবন এবং গ্রামীণ পরিবেশ জিনের ঝকি কমাতে সহায়তা করে। পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতা যেহেতু মাদকের শুরুতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তাই মাদক নেয়া থেকে বিরত রাখতে হলে অবশ্যই সন্তানদের সময় দিতে হবে। বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কী করে তার খবর রাখতে হবে। পড়াশোনার উন্নতিতে নজর দিতে হবে। পরিবারে মাদকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মাদকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, মাদক থেকে ফেরানোর এটাই গুরুত্বপূর্ণ সময়। একবার মাদকের স্বাদ পেলে তখন এসবে আর কাজ হয় না। ঐশীর মতো মাদকাসক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা না করে বাসায় আটকিয়ে রাখলে, কড়া শাসন দেখালে হিতে বিপরীতই হবে।
মাদকাসক্তিতে Gateway Hypothesis নামে একটা কথা আছে অর্থাৎ মাদকের শুরু হয় সিগারেট, মদ দিয়ে, আস্তে আস্তে তা গাঁজায় গড়ায় এবং তারপর কঠিন নেশার কবলে পড়ে। তাই সিগারেট, মদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর করতে হবে। পরিবারে এগুলোর প্রভাব কমাতে হবে বা বন্ধ করতে হবে। কম বয়সে যেন সিগারেটের মজা না পায় তা খেয়াল রাখতে হবে। এতে করে অন্য নেশায় চলে যাওয়ার ঝুঁকিও কমে যাবে। যেহেতু মাদকাসক্তির জিনের সঙ্গে আচরণগত জিনের সম্পর্ক আছে বা একই জিনই উভয় রোগে ভূমিকা রাখে, তাই আচরণগত খারাপ রোগীরা সবসময়ই মাদকাসক্তির ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পরিবার সচেতন হলে মাদকের ব্যবহার কমে যাবে। আর মাদকের ব্যবহার কমলে মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব এবং মাদকাসক্তিও কমে যাবে।
** লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে