দাম্পত্য জীবনেও যৌন নির্যাতন!

দাম্পত্য জীবনেও যৌন নির্যাতন!

মিতু আর একটা দিনও সংসার করবে না। সকালে ঘুম ভেঙে গেলে এই চিন্তাটাই তার মাথায় প্রথম এল। অথবা এই চিন্তা করতে করতেই মিতুর ঘুম ভেঙে গেল। মন ভালো নেই। মাথাটা ধরে আছে। মিরাজ যে রাতেই তার সাথে থাকে সে রাতেই তার কষ্ট হয়। সকালে মাথা ধরে থাকে। সংসার ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয় না। ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় হোক বিয়ের পর দশ বছর হতে চলল এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার জীবন। ছেলেপুলে নেই। থাকলে হয়ত বলা যেত ওদের মুখ চেয়ে আর কোথাও যাওয়া হলো না। কিন্তু সেসব না বলেও সে আছে। বিয়েটা সে যত সহজে করতে পেরেছিল ঠিক ততটা সহজে ভেঙে দিতে পারছে না।

বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতে সে বুঝতে পেরেছিল মিরাজের ভালোবাসায় গড়মিল আছে। বুঝতে পারলেও ধরতে পারেনি ঠিক গড়মিলটা কোথায়। মিরাজের ক্রেজিনেস, কেয়ারিং সবকিছুই এক সময় সে উপভোগ করত। এখন অসহ্য লাগে। সবছিুর মধ্যে মিরাজের প্রবল উপস্থিতিই সে টের পায়। মিতু ছোট হতে হতে শূন্য হয়ে গেছে। মিরাজের কাছে এখন সে শূন্যই। সেই কবে মিরাজ তাকে আদর করে কাছে নিয়েছে মনে নেই। কবে সে মিরাজের গায়ে বিশেষ প্রয়োজনে হাত রেখেছে মনে নেই। শুধু মনে থাকে, হঠাৎ করে মিরাজের তার ওপরে চড়ে বসা। চড়েই বসে সে। উন্মত্ত ষাড়ের মতো। ঘৃণায় মিতু কুঁকড়ে ওঠে। বেদনায় নীল হয়ে যায়। রাতের পর রাত মিরাজের কাছে ব্যবহৃত হতে হতে এখন নিজের ওপরই ঘৃণা হয়। কিন্তু সেসবের কোনোটাই ধর্ষণ নয়। তেরো বছরের ওপরের কোনো মেয়ে বাংলাদেশের পেনাল কোডের ভাষায় স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হয় না। অন্তত ধর্ষণের কথা বলে ডিভোর্স চাওয়া যায় না। তাই তার আর বিচার চাওয়া হয় না। আইনের চোখে যা অপরাধ নয় তার জন্য বিচার চাইতে যাবে সে কোন আদালতে?

সুস্থ সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মিউচুয়্যালিটি বা পারস্পরিকতা। যৌনতা নারী পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কের অন্যতম অনুষঙ্গ। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ইচ্ছা-অনুভূতি না থাকলে একজন আরেকজনের কাছে ব্যবহারের সামগ্রী হয়ে পড়ে। তখন যৌন নির্যাতনের প্রশ্ন আসে। যদিও আমাদের দেশের আইনে ‘ম্যারেইটাল রেপ’ বলে কোনো কথা নেই। কিন্তু যে ক্রমাগত এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় সে জানে জীবনটা তার জন্য কতটা দুর্বিষহ।

সুস্থ স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে এ ধরনের যৌন নির্যাতন দেখা যায় না। অসুস্থ সম্পর্কে যৌন নির্যাতন একটি ক্রনিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, যৌন মিলনে বাধ্য করা ছাড়াও আরো অনেক ধরনের যৌন আচরণে বাধ্য করাও যৌন নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে যেমন-সেক্স করার সময় গালাগালি করা, আজেবাজে মন্তব্য করা, সঙ্গীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখমৈথুন করা ইত্যাদি।

সবচেয়ে বড়ো কথা, যে নিপীড়িত হচ্ছে সে কীভাবে দেখছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। এইসব আচরণের ফলে বিষণ্ণতা, কনভার্সন ডিজঅর্ডার, সেক্সুয়াল ডিজফাংশন, আত্মপীড়ন এমনকি আত্মহত্যার মতো মারাত্মক মানসিক অবস্থা দেখা দিতে পারে। সম্পর্কের অবনতি তো আছেই। যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন বলতে সাধারণত আমরা ধর্ষণকেই বুঝি। সেই ধর্ষণ আবার অপরিচিত মানুষের দ্বারা হচ্ছে এমনটাই ধারণা আমাদের। এমন ধারণা হয় এই কারণে যে, অপরিচিত লোকের দ্বারা ধর্ষণ হলে সেটা যেমন প্রচার পায় পরিচিত লোকের দ্বারা হলে সেটা তেমন প্রচার পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেপে যাওয়া হয়। আর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ হলে সেটা যেমন আমাদের দেশে আইনের চোখে কোনো অপরাধ বলে চিহ্নিত হয় না তেমনি সমাজও কোনো অন্যায় বলে মনে করে না।

সমাজে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, যৌন তাড়না তীব্র হলে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যৌন তাড়না নিয়ন্ত্রণযোগ্য। বিশ্বের একশটি দেশে ম্যারেইটাল রেপকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এবং অপরাপর ধর্ষণের মতো এ ধরনের ধর্ষণে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে ।

ধর্ষণ যে ধরনেরই হোক না কেন পরিচিত বা অপরিচিত যার দ্বারাই সংগঠিত হোক না কেন এ ধরনের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। ইনডিভিজুয়াল বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে নিজেকে দোষারপ করতে শুরু করে। তার খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে পরিচিত কারো দ্বারা ধর্ষিত হলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যায়, লোক চিনতে ভুল হয় বলে। এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা দেয়। প্রাত্যহিক বা দৈনন্দিন কাজকর্মে পূর্বের মতো সক্রিয় থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। অন্যের প্রতি ভয়, অবিশ্বাস কাজ করে। স্বামীর কাছে ধর্ষিত হয় বলে নিজের ঘরকেও নিরাপদ মনে হয় না। অনেকে আবার বুঝতেই পারে না সে ধর্ষিত হচ্ছে। সে তার খারাপ লাগা বা প্রতিক্রিয়াকে অতি সংবেদনশীলতা মনে করে। পরবর্তীতে তার মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।

আমাদের করণীয়
যদিও পরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণ হলে জানাজানিটা কম হয় তবে অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের চেয়ে পরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত হলে মানসিক চাপ অনেক বেশি হয় এবং এ ধরনের ধর্ষণ তুলনামূলক বেশি হয়। তাই আমাদের কিছু কথা মনে রাখা প্রয়োজন। যেমন :

  • লক্ষ রাখা সে যেন সমাজ থেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে।
  • অনেক সময় ধর্ষণকারীর সঙ্গেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মনে রাখা প্রয়োজন এটা তার জন্য হিতে বিপরীতও হতে পারে।
  • ম্যারেইটাল রেপের ক্ষেত্রে কাছের মানুষদের মনে হতে পারে সে কেন এখনো ঐ লোকের ঘর করছে। কেউ কেউ হয়ত বলেও ফেলেন। এতে ভিক্টিমের কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না। বরং কোনো ধরনের কোনো মন্তব্য না করে তাকে বোঝার জন্য তার কথাগুলো শুনুন। এতে সে কিছুটা হলেও হালকা বোধ করবে।
  • মানসিক রোগ দেখা দিলে মানসিক চিকিৎসার জন্য মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলুন।
  • তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করুন।
  • এ বিষয়ে কাউন্সেলিং সেবা নিতে বলুন।

মনে রাখবেন, একজন মানুষ যখন তার নিজের আবেগ অনুভূতি চিন্তা-ভাবনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখতে পারে, তার জীবনের কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারে এবং পাশাপাশি অপর মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে তখনই সে মানসিকভাবে সুস্থ আছে বলা যায়। সেই অবস্থায় ফিরে যেতে আপনার সহযোগিতা হোক তার জীবন পথের পাথেয়।

**লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমন খারাপ থাকলে যা করতে পারেন
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here