আজকালকার পাঠকদের অনেকের হয়ত বা জানা নেই, একসময় ঘড়িগুলো ছিল যান্ত্রিক। এসব ঘড়িতে দিনের নির্দিষ্ট সময় পরপর চাবি দিতে হতো, না দিলে ঘড়ির সময়ও হয়ে যেত এলোমেলো। ঘড়ির এই বৈশিষ্ট্য দেখে বোধহয় অনেক লোকজ গানে আমাদের দেহটিকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করে রূপক অর্থে বলা হয়েছে দেহঘড়ি।
এই দেহঘড়ির মাঝে আরেক ঘড়ি হলো ঘুমের ঘড়ি। মাদক এই ঘুমের ঘড়িটিতে জোর করে উল্টাপাল্টা চাবি দিয়ে দেয়। ঘুম মানুষের জীবনের এক রহস্যময় সময়। আমাদের জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটে ঘুমে। এই ঘুমের মাঝেই শরীর টুকটাক মেরামতের কাজ সেরে ফেলে, মস্তিষ্কের কোষে সারাদিন জমে যাওয়া বিভিন্ন অদরকারী রাসায়নিক বের করে দেয়। এসময় আমরা স্বপ্নও দেখি। এসব স্বপ্নের কিছু মনে থাকে, কিছু মনে থাকে না। দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা, মুখ, আশা, কল্পনা স্বপ্নে বিভিন্ন রূপ ও রূপকে ফিরে আসে।
বাচ্চাদের ঘুমের সময় একটু খেয়াল করলে দেখবেন ঘুমের মাঝে কখনো কখনো তাদের চোখের পাতা পিট পিট করে নড়ছে। এর নাম র্যাপিড আই মুভমেন্ট। ঘুমের রহস্যের মাঝে আরেকটি রহস্যময় সময় এটি। গবেষণায় দেখা যায়, এসময়ে দেখা স্বপ্নগুলো সাধারণত আমাদের মনে থাকে এবং মস্তিষ্কে ধুন্ধুমার কাজকর্ম চলে ঠিক যেমনটি চলে জেগে থাকার সময়। ঘুমের এসময়টিতে আমাদের মস্তিষ্ক জমে থাকা তথ্যগুলো গোছায়, স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে। একটা স্বাভাবিক একরাতের ঘুমে কমপক্ষে চার বার রেম ঘুমের চক্র না এলে আমাদের মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে, অস্থির, কাজে কর্মে মনোযোগও কমে যায়। মাদক নামের রাসায়নিকগুলো দিনের পর দিন আমাদের ব্রেইনে ঢুকে পড়তে থাকলে ব্রেইন স্বাভাবিক ঘুমের আর এই চক্র অনুসরণ করতে পারে না। সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দিন যত গড়ায় আমরা তত সূর্যের আলোর মুখোমুখি হই এবং আমাদের মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নামক একটি রাসায়নিক ঝরতে থাকে। এভাবে রাতের দিকে যখন নির্দিষ্ট পরিমাণ মেলাটোনিন জমে যায়, তখন শরীর মনে করে ‘সারাদিন যথেষ্ট হয়েছে কারবার-এখন এসেছে সময়, ঘুমাবার’। তখন সজাগ রাখার রেটিকুলার অ্যাকটিভেটিং সিস্টেম নামক একটি সিস্টেম যার সামগ্রিক কাজের ফলাফল হচ্ছে আমাদের জেগে থাকা, তা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে। অনেকটা কম্পিউটারের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের শাটডাউনের মতো ধীরে ধীরে একটি একটি করে প্রোগাম বন্ধ হতে থাকে। এমন অবস্থায় কম্পিউটারে নতুন করে একটি প্রোগ্রাম চালু করতে চাইলে যেমন সমস্যা হয় তেমনি এমন ঘুমের ঝোঁকের সময়টিতে আমরা যদি উত্তেজক কোনো মাদক নেই, কিছু দেখি, ভাবি, করি তবে সামগ্রিক সিস্টেমটাতে একটা ভজঘট ঘটে যায়।
উত্তেজক বা স্টিমুল্যান্ট শ্রেণির নামের মাঝেই তার কাজের পরিচয় পাওয়া যায়। এ শ্রেণির মাঝে পড়ে নিকোটিন (বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দা, সাদা পাতা), ক্যাফেইন (চা, কফি, চকলেট), মিথামফেটামিন (ইয়াবার প্রধান উপাদান), কোকেন ইত্যাদি। এ ধরনের মাদক নিলে মানুষের উত্তেজনা বাড়ে, স্বাভাবিক ঘুম কমে যায়, অতি সচেতন হয়ে ওঠে, খাওয়াদাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, কাজের সংখ্যা বাড়ে, মান কমে। এভাবে যত দিন যায় তত ঘুমের ব্যাংক ব্যালান্সে ঘাটতি পড়ে।
এর মানে হচ্ছে-স্বাভাবিকভাবে যেখানে আমাদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর কথা, সেখানে যদি দিনে গড়ে দুই ঘণ্টা করে ঘুমাই তবে দিন প্রতি আমাদের ঘুমের ঘাটতি হলো, ৭-২= ৫ ঘণ্টা (যদি স্বাভাবিক সর্বনিম্ন ঘুমের সময় ধরা হয় ৭ ঘণ্টা)। তাহলে এক সপ্তাহ কেউ যদি নিয়মিত ইয়াবা নেয়, তবে তার এক সপ্তাহে ঘুমের ঘাটতি হলো সর্বমোট ৫দ্ধ৭= ৩৫ ঘণ্টা। এ পর্যায়ে স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে কেউ যদি ইয়াবা নেয়া বন্ধ করে দেয় তখন আমাদের শরীর তার বকেয়া ঘুম পুষিয়ে নেয়া শুরু করে-অর্থাৎ আমরা তখন স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি ঘুমাব। উত্তেজক মাদকের ঠিক উল্টো প্রক্রিয়ায় আরেক শ্রেণির মাদক মানুষের উদ্বেগ,উত্তেজনা, ভয়গুলোকে রাসায়নিকভাবে চাপা দিয়ে রেখে দেহ-মনে একটা উদ্বেগশূন্য শান্তির আবহ তৈরি করে। এতে করে শরীর স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের ঘুম পায়। শক্তিশালী ব্যথানাশক (প্রাকৃতিক কিংবা সিনথেটিক) হেরোইন, মরফিন, ফেনসিডিল ব্যথা যেমন কমায় তেমনি শরীর-মন শিথিল করে ঘুম ঘুম ভাব এনে দেয়। এরকম পরোক্ষ ভূমিকার বদলে সরাসরি কিছু মাদক ঘুম বাড়িয়ে দেয়। এদের মাঝে পড়ে অ্যালকোহল, বেনজোডায়াজিপাইন। মস্তিষ্ককে নিস্তেজ করে দেয় বলে এ ধরনের মাদকগুলোকে বলে ডিপ্রেসেন্ট বা নিস্তেজক। গাঁজা কোনো শ্রেণির সাথে ঠিক খাপ খায় না। ধোঁয়া হিসেবে নেয়া গাঁজার পরিমাণ, গুণগত মান এবং দম নেয়ার ঠিক আগমুহূর্তের আবেগ, প্রত্যাশা, কোথায় বসে নেয়া হচ্ছে-এসব কিছুর ওপর নির্ভর করে গাঁজা কখনো উত্তেজক, কখনো নিস্তেজক।
আসলে মাদকের রসায়নভেদে একেক মাদক ঘুমের ক্ষেত্রে একেক রকম করে প্রভাব ফেলে। কেউ ঘুম বাড়ায়, কেউ কমায়। যতক্ষণ সময় মাদক রক্তে পূর্ণ মাত্রায় থাকে ততক্ষণ থাকে তার প্রাথমিক প্রভাব। সময় যত এগোয় তত রক্তে মাদকের মাত্রা কমতে থাকে। আমাদের শরীর নামের বিশাল কারখানার রাসায়নিক পরীক্ষাগার লিভার মাদক নেয়ার পর থেকে মাদকের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। ফলাফল হচ্ছে মাদক ভেদে ১ থেকে ১২ ঘণ্টার মাঝে রক্তে মাদকের মাত্রা, প্রাথমিক মাত্রার অর্ধেক হয়ে যায়। এরপরেই শুরু হয় অ্যাকিউট উইথড্রয়াল বা তীব্র প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ। এ পর্যায়ে ঘটে একবারে উল্টো ব্যাপার। মানে মাদক নেওয়ার পর শরীরে যে যে সিস্টেমগুলো চাপা দিয়ে রাখা ছিল তা স্প্রিংয়ের ওপর চাপ ছেড়ে দেয়ার মতো করে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। অর্থাৎ যে মাদকটি নিলে খুব ঘুম ঘুম পেত এই সময়ের পরপর মাদক না পেলে এক্কেবারে ঘুম হবে না। আবার যে ধরনের মাদক প্রাথমিকভাবে চোখ থেকে ঘুম নাই করে দেয়, সেসব মাদক শরীর আর না পেলে উইথড্রয়াল হিসেবে দেখা যাবে অতিরিক্ত ঘুম। মাদকের কারণে ঘুমের স্বাভাবিক চক্রের এইসব বিকৃতি মাদক নেয়া ছেড়ে দেয়ার দু-এক সপ্তাহের মাঝে চলে যায় না। পোস্ট অ্যাকুইট উইথড্রয়াল বা প শিরোনামের ৬টি লক্ষণের একটি হয়ে রিল্যাপ্সের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে রয়ে যায়।
শুধুমাত্র ঔষধ দিয়ে মাদক থেকে উদ্ভূত ঘুমের সমস্যার সমাধান নেই। ঔষধের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, পরিমিত আহার, ব্যায়াম, মানসিক চাপ নেশার টানের ব্যবস্থাপনা, বিনোদন, স্লিপ হাইজিন বা ঘুমের নিয়মকানুন ইত্যাদি অনুসরণ করতে পারলে মোটামুটি স্বাভাবিক ঘুমের চক্র ফিরে আসতে সময় লাগে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছর। তবে ঘুম স্বাভাবিক হয়ে গেলেই এইসব নিয়মকানুন মানা ছেড়ে দিলে চলবে না। রিকভারি অর্জন এবং ধরে রাখতে হলে ইতিবাচক জীবনযাপনের এই নতুন ধরন অনুসরণ করতে হবে আজীবন।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে