পরিবার ও নারী-একই সূত্রে গাঁথা। একটি পরিবারকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করতে নারীর অবদানই সিংহভাগ। বেশিরভাগ পরিবারে পুরুষের প্রধান ভূমিকা হলো অর্থ উপার্জন, বাদবাকি সব দায়িত্ব বর্তায় স্ত্রী চরিত্রের ওপর-হোক সে কন্যা, জায়া, জননী। তো এই অর্থ উপার্জনের ভূমিকা পুরুষকে এতই অহংকারী করে যে, সে ভুেল যায় পরিবারে নারী চরিত্রের অবদান ও অবস্থান।
এছাড়াও সামাজিক, ধর্মীয় অনুশাসন ও পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে নারী নির্যাতন এখন নিত্যকার খবর। আর শুধু পুরুষদেরই বা দোষ দেই কেন! পরিবারের নারী সদস্যরাও অনেক সময় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নারী নির্যাতন করছে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বউ-শাশুড়ি-ননদ দ্বন্দ্ব এবং বাড়ির বউয়ের ওপর নির্যাতন।
পারিবারিক পরিমন্ডল ছাড়াও কর্মক্ষেত্রেও নারী নির্যাতনের উদাহরণ কম নয়। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আছে নারীর প্রতি অমানবিক নিগ্রহ। নারী নির্যাতন মূলত তিন ধরনের-
- শারীরিক নির্যাতন
- মানসিক নির্যাতন
- যৌন নির্যাতন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১’ নামে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই জরিপে দেখা যায় যে, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫% শারীরিক নির্যাতন, ৩৬% যৌন নির্যাতন, ৮২% মানসিক ও ৫৩% অর্থনৈতিক নির্যাতন।
এ চিত্র শুধু উন্নয়নশীল দেশের নয়, উন্নত বিশ্বের জরিপেও দেখা গিয়েছে একই তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪টি পরিবারের একটিতে গৃহ নির্যাতন চলছে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়াতেও এই হার ২৫ ভাগ।
প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন-আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের ধারাটি হলো ‘মানসিক নির্যাতন’। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও তাই নির্যাতনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের প্রভাবটাও মনের ওপরই পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক আঘাত অনেক মর্মস্পর্শী এবং তা মানুষকে দীর্ঘদিন কষ্ট দেয়।
সাধারণভাবে নারী নির্যাতনের প্রভাবে নারী সাময়িক মনঃকষ্ট, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং আতঙ্কে ভোগে। এছাড়াও নির্যাতন নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে গুরুতর মানসিক রোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিম্নোক্ত রোগগুলো তার মধ্যে অন্যতম :
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) বা গুরুতর আঘাত পরবর্তী চাপজনিত ব্যাধি
নারীর ওপর চালানো ভয়ংকর সহিংসতা, গুরুতর যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ এ রোগের উৎপত্তি ঘটায়। রোগীর মধ্যে অত্যধিক উদ্বেগ (Hyper arousal) ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক, দুঃস্বপ্ন দেখা, নির্যাতনের স্থানকাল এড়িয়ে চলাসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয় এবং তা তার দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
বিষণ্ণতা
নির্যাতিত নারী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবে-এটাই স্বাভাবিক। কোনো কোনো সময় স্বাভাবিক মন খারাপের মাত্রা ছাড়িয়ে ‘বিষণ্ণতা’ রোগের পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
উদ্বেগজনিত রোগ
নির্যাতনের স্বাভাবিক মনোজাগতিক প্রভাব হলো সার্বক্ষণিক উদ্বেগ এবং আবারো নির্যাতিত হওয়ার আতঙ্কে অস্থির থাকা। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যে, নারী দৈনন্দিন জীবনে আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। তার কাজকর্মে ক্রমাগত ভলুভ্রান্তি ও অবহেলা দেখা দেয়। এইসবই আবারো নির্যাতনের পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।
মনোদৈহিক রোগ (সাইকো সোমাটিক ডিজঅর্ডার)
নির্যাতিত নারীর এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এ রোগে রোগী নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সম্মখুীন হয় যার কোনো শরীরবত্তৃীয় কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন লক্ষণগুলো হলো-মাথাব্যথা, পেটব্যথা, বুকে ব্যথাসহ শরীরের নানা অংশে ব্যথার প্রকোপ হওয়া, শ্বাসকষ্ট, অনিদ্রা, কোষ্ঠকাঠিন্য, গা-হাত-পা জ্বালাপোড়া করা এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
কনভার্সন ডিজঅর্ডার (Conversion Disorder)
নির্যাতনজনিত মানসিক চাপ নানাবিধ শারীরিক উপসর্গে রূপান্তরিত হয় বলেই একে Conversion Disorder বলে। হাত পায়ে শক্তি না পাওয়া, খিঁচুনি, ঘন ঘন অজ্ঞান হওয়া, অস্বাভাবিক আচরণ করা থেকে শুরু করে নানাবিধ স্নায়বিক সমস্যার মাধ্যমে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
মনোযৌন রোগ (সাইকোসেক্স্রয়ুাল ডিজঅর্ডার)
এটি সাধারণত যৌন নির্যাতনের প্রভাবে হয়। তবে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের ফলেও একজন নারী স্বাভাবিক যৌন জীবনযাপনের আগ্রহ, ইচ্ছা, তাড়না হারিয়ে ফেলতে পারে।
আহারজনিত মানসিক রোগ (Eating Disorder)
রোগী ক্ষধুামন্দা, অরুচি, বমিভাব, গ্যাসজাতীয় সমস্যা, হজমের সমস্যা থেকে শুরু করে মারাত্মক সব আহারজনিত মানসিক রোগের সম্মখুীন হতে পারে। মাদকাসক্তি : নির্যাতনের কষ্ট সাময়িকভাবে ভুলে থাকার জন্য নেশার আশ্রয় নেয়া অস্বাভাবিক নয়। যা পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি আসক্তি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
আত্মহত্যা বা আত্মহত্যা প্রবণতা
নির্যাতিত নারী অনেক সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের ক্ষতি করে। এমনকি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পরিণতিও বেছে নিতে পারে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, পারিবারিক নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় যা ঐ শিশুটির/মেয়ে শিশুটির মধ্যে জন্ম দিতে পারে কোনো ভবিষ্যৎ মনোবৈকল্য। যেকোনো অর্থে ‘নির্যাতন’ একটি নেতিবাচক শব্দ। আমাদের সকলের উচিত এর বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া; প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং নির্যাতিতের পক্ষে সহায়তার হাত প্রসারিত করা। আর মানসিক স্বাস্থ্যহানি হলে উপযুক্ত চিকিৎসা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে