করোনার ক্রান্তিকালে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

করোনার ক্রান্তিকালে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
করোনার ক্রান্তিকালে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

একজন কোভিড পজেটিভ রোগীকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন, কেমন আছেন? তিনি কান্নাসুরে বলবেন- ‘দুনিয়া এতো নিষ্ঠুর কেনো? আমি কি কিছুই করিনি সবার জন্য? সবাই আমাকে এভাবে এভোয়েড করছে? আমি বোধ হয় বাঁচবোনা!’ ভালই লিখেছেন ডা. মানিক মজুমদার। কোভিড আক্রান্তদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন। কোভিড রোগীর এই যে বিচ্ছিন্নতা এটা একটা বড় ধরনের এ্যাংজাইটির কারণ।

মানুষ তার সকল অনিশ্চয়তা ভুলে থাকতে চায় মানুষের মাঝে। মানুষ বেঁচে থাকার স্বার্থেই মানুষকে ভালবাসে। জোট বাঁধে। মানুষের যতগুলো আবেগ আছে তার সবগুলো মৌলিক নয়।মৌলিক আবেগের সংখ্যা মাত্র সাতটি। এই সাতটি আবেগের মধ্যে যত্ন একটি শক্তিশালী আবেগ। যত্ন করা এবং যত্ন পাওয়া দুটোই এই আবেগের মধ্যে আছে। সম্পর্ক,নিরাপত্তা,ভালবাসা, সংযুক্তি এগুলো যেমন এই আবেগের ইতিবাচক দিক। অর্থাৎ যত্ন আবেগটি আছে বলেই এই মিশ্র আবেগ গুলো সৃষ্টি হয়।তেমনি যত্ন আবেগের অভাবে বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, আতঙ্ক,বিষন্নতা, কষ্ট শোক সৃষ্টি হয়।

বিচ্ছিন্নতা আবেগটি যখন সৃষ্টি হয় আমরা বলি সেপারেশন এ্যাংজাইটি। এই সেপারেশন এ্যাংজাইটির ফলে শরীরে ডিফিউজ ফিজিওলজিক্যাল এরাউজাল হয়। যা বোঝা যায় পালস রেট বেড়ে যাওয়া এবং কোষে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। ফেইসবুকে ডা. মানিক মজুমদারের লেখা ছাড়াও আরো কয়েকজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার বিবরন থেকে সেটা বুঝতে পারলাম। বিশেষ করে আমার শিক্ষক প্রোফেসর ডা.আব্দুল ওয়াহব এর নিজস্ব বিবরণীতে শোনা উনার দেখা একজন রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছিল কিন্ত যখন অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসা হলো তখন সেটা দেখা মাত্র পালস অক্সিজেন মিটারে রিডিং বদলে গেলো। অক্সিজেনের নল রোগীর নাকে প্রবেশ করানোর আগেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন বেড়ে যাওয়া থেকেই এটাই বোঝা যায় যে এ্যাংজাইটি কিভাবে আমাদের উপর শারীরিক প্রভাব ফেলে। তাহলে কোভিড নিউমোনিয়াতে যিনি ভুগছেন তিনি যদি কোভিডের পাশাপাশি এ্যাংজাইটিতেও ভোগেন তাহলে সেটা তার অসুস্থ শরীরের উপর কি ভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

তাই এ্যাংজাইটি কমানো এই চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অনুষঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে কোভিড গাইড লাইন বেরিয়েছে সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে এ্যাংজাইটির বিষয়টি আছে। কিছুদিন আগে বিএসএমএমইউয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রোফেসর ডা.সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব কোভিড আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে স্যারের সাথে তার স্ত্রীও ছিলেন। স্যারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও স্যার লিখেছেন চিকিৎসার সময় পাশে একজন সঙ্গী থাকলে ভাল হয়।

আমাদের হাসপাতালে জনবল এমন নয় যে একজন রোগী হাসপাতালে একা একাই তার চিকিৎসা করাবেন। অন্যান্য সময় রোগীদের সাথে সব সময় ই সাহায্যকারী একজন থাকেন। কিন্তু কোভিডের সময় সেটা সম্ভব হচ্ছে না বা আমরা উৎসাহিতও করতে পারছি না সংক্রমনের ভয়ে। কোভিড হলেই যে হাসপাতালে ভর্তী থেকে চিকিৎসা নিতে হবে বিষয়টা এমনও নয়। তবে পরিবার পরিজনের সাহচর্য না পেলে একজন রোগীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে যেতে পারে। এই বিষয়টা মাথায় রাখা প্রয়োজন।

কিছু মানসিক স্বাস্থ্য বিধি আমরা মেনে চলতে পারি এই সময়ে:
১. সংক্রমন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট হাতের কাছে রাখা এবং যথাযথ ব্যাবহার বিধি মেনে ব্যাবহার করা।
২. শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে বাড়ে সে ভাবে সুষম খাবার খাওয়া। বিশেষ করে ভিটামিন সি,জিঙ্ক সমৃদ্ধ ফল মূল, শাক সবজি খাদ্য তালিকায় রাখা। ফ্রোজেন ফুড এড়িয়ে চলা। ভেষজ কিছু দ্রব্য ব্যাবহার করা যেমন কালোজিরা, লবঙ্গ, আদা, মধু, গ্রীন টি খাওয়া।
৩. পরিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সাথে কোয়ালিটি সময় দেওয়া। কোয়ালিটি মানে সত্যি সত্যি তাদেরকে অনুভব করা, তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।
৪. পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্য বিধি মেনে তার যত্ন নেওয়া। তার প্রতি খেয়াল রাখা যাতে বিচ্ছিন্নবোধ না করেন।
৫. নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। একটা রুটিন মেনে চলা। পরিবারের সদস্যদের সাথে ইন্টারআ্যাকশন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া।
৬. পরিবারের শিশুদের, বয়স্কদের যত্ন নেওয়া। শিশুরা যেন এ সময়ে অতিরিক্ত ডিভািস ব্যবহার না করে। তাদেরকে সঙ্গ দিন। বয়স্কদের সাথে কথা বলুন। তারা যেন নিঃসঙ্গ বোধ না করে সেদিকে খেয়াল রাখুন।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleকোভিড ১৯: লকডাউন-ডিপ্রেশন এবং একজন সুশান্ত সিং রাজপুত
Next articleসামাজিকভাবে ফেসশিল্ড ব্যবহার: করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের বৈজ্ঞানিক ও সহজ পদ্ধতি
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here