মৃ্ত্যুশোক: স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া

মৃ্ত্যুশোক: স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া
মৃ্ত্যুশোক: স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া

জন্মের ক্ষণ থেকেই মৃ্ত্যুর দিকে পথচলা শুরু হয়ে  যায়। প্রতিটি জীবনই মহাসত্যের দিকে নিয়ত ধাবমান, প্রাণের প্রতিটি অস্তিত্বই একই পরিণতিতে শেষ হয়েছে,হবে। এই পরিণতি হলো প্রাণের ধ্বংস, জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্য তো মৃ্ত্যুই। তবে সেটা যদি হয়প্রিয়জনের, তাহলে সেই দুঃখ সহজে ভোলার নয়।  তাই বাইবেল  ‍যুক্তিসঙ্গতভাবেই মৃ্ত্যুকে ‘শেষ শত্রু’বলে উল্লেখ করে (১ করিন্থীয় ১৫:২৬)।

প্রিয়জনের মৃ্ত্যুতে আমাদের জীবন ওলটপালট হয়ে যায়, শোকে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি, যেন একটি ঝড় এসে মানুষটিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। পবিত্র কোরআন শরীফের সূরা আল-ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে উল্লেখিত আছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ
করবে’ (সরা আল-ইমরান, ১৮৫ নং আয়াত)।

কীভাবে একজন ব্যক্তি প্রিয়জন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারে? শোক কাটিয়ে উঠতে কত সময় লাগে? কীভাবে একজন শোকার্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দেয়া যায়?

স্বাভাবিক মৃত্যুশোক
মৃ্ত্যুর মধ্য দিয়ে প্রিয়জন বিয়োগের পীড়ন ও শোকাবহ অবস্থাকে স্বাভাবিক মনোবেদনা বলে। এতে অনৈচ্ছিক আবেগীয় ও আচরণগত প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটে।ব্যক্তি প্রিয়জন বিয়োগের ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে নতুন সম্পর্কে গমন করতে সমর্থ হয়। প্রিয়জন বিয়োগে কাছের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশীর সমন্বয়ে সামাজিকভাবে অনুমোদিত রীতিনীতি পালিত হয়, তবে তা সমাজ ও ধর্ম অনুসারে  স্থায়িত্ব ও গঠনে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মৃ্ত্যুশোক একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কালের পরিক্রমায় তিনটি পর্যায়ে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

প্রথম পর্যায় : প্রিয়জন বিয়োগের ঘটনা ব্যক্তির নিকট ১-২ সপ্তাহ অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব মনে হয়। নিতান্তই কম আবেগীয় প্রকাশ ঘটে, মৃ্ত্যুর ঘটনা সে আংশিকভাবে গ্রহণ করে নেয় এবং অস্থিরতা বিরাজমান থাকে যেন সে প্রিয়জনকেই এখানে সেখানে খুঁজছে।

দ্বিতীয় পর্যায় : ব্যক্তি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে,একাকিত্ব এসে ভর করে, প্রায়ই সে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা অনুভব করে। ব্যক্তি  দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, ঘমের ও রুচির ব্যাঘাত ঘটে ও অযাচিত আতঙ্কে পতিত হয়। কোনো কোনো শোকে কাতর ব্যক্তি ক্রোধান্বিত হয়ে নিজেকে বা চিকিৎসককে দোষারোপ করতে থাকে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার ঘাটতিকে মৃ্ত্যুর জন্য দায়ী করে। দশ জনের মধ্যে একজন সংক্ষিপ্ত সময় যাবৎ মৃত ব্যক্তিকে দেখতে পায় বা অনভব করে বা তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। প্রিয়জনের সঙ্গে কাটানো সুখস্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। এ সময় সামাজিক মেলামেশাতে ঘাটতি হয় এবং নিকটজনের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ৬ মাস থেকে ১ বছর যাবৎ মানসিক ও শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন চলতে থাকে।

তৃতীয় পর্যায় : শোকার্ত ব্যক্তির শোকের তীব্রতা ফিকে হয়ে আসে। আস্তে আস্তে পারিবারিক, সামাজিক সকল কাজে সে দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। তবে মাঝে মাঝে প্রিয়জনের সাথে কাটানো সুখস্মৃতিরা উঁকি দেয়। পারিবারিক সদস্যদের মিলনে বা সুখস্মৃতি বা মৃ্ত্যুবার্ষিকীতে নিকটজনদের মৃতের প্রতি প্রবল মনোবেদনা পনরুদ্দীপিত হতে পারে।

অস্বাভাবিক গভীর ও প্রবল মনোবেদনা,মর্মযন্ত্রণা
মৃ্ত্যুশোককে আমরা তখনই অস্বাভাবিক বলতে পারি যখন এটি যথাসময়ের পরে হয় বা দমিত থাকে বা লক্ষণীয়ভাবে তীব্র হয় বা দীর্ঘায়িত হয়। এই ধরনের প্রবল মনোবেদনাকে জটিল, ত্রুটিপূর্ণ অস্বভাবী মনোবেদনা বলে। এই অস্বভাবী মর্মযন্ত্রণার উপস্থিতি গুরুতর বিষণ্ণতা রোগের পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মনোবিজ্ঞানী সিমন হাস্লামায়ারের মতে আপনজনের মৃ্ত্যুর শোকে কাতর শতকরা ৭ জন অস্বভাবী মর্মযাতনায় ভগে থাকে। এই মর্মযাতনাকে তিন ধরনের নমনায় বর্ণনা করা যায় :

দীর্ঘায়িত বা ক্রনিক:বেশিরভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি মৃত আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা ও তার আদর্শায়নের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতে পারে। শোকে বিহ্বল ব্যক্তির আপনজনের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ট বা দ্বিমখী বা নির্ভরশীলতার সম্পর্ক থাকতে পারে, সামাজিক সমর্থনের অভাবে বা যখন এত দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ ভাগ করে নেয়ার জন্য শোকে কাতর ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে কাছে পাওয়া যায় না। স্বজনের মৃ্ত্যুর ৬-১২ মাস পরেও ব্যক্তি মর্মযাতনায় ভগতে পারে।

অতি তীব্র বা হাইপার ট্রাফিক:প্রিয়জনের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মৃ্ত্যুতে শোক অস্বভাবিকভাবে তীব্র হতে পারে। প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুল কামনায় জীবনকে অর্থহীন মনে হতে পারে, আত্মসংবরণের প্রথাগত কৌশলাদি এতে অকার্যকর হয়। ফলে অযাচিত চিন্তাভাবনা প্রশমনে ব্যক্তির যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এবং বারংবার শোকের তীব্রতা ভয়াবহ আকারে ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। পরিবারের কোনো একজন সদস্য এই প্রতিক্রিয়ায় ভুগলে সামগ্রিকভাবে পরিবারের স্থিত অবস্থায় ভাঙন ধরে।

বিলম্বিত বা দমিত: প্রিয়জনের মৃ্ত্যুতে জীবিত ব্যক্তি অনিশ্চিত জীবনের উৎকণ্ঠায় বা সাথে ছোটো শিশুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হলে বা ব্যক্তি মানসিক রোগে ভুগে থাকলে মৃ্ত্যুশোকের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিক্রিয়াগুলো সপ্তাহ দুই পরে পরিলক্ষিত হতে পারে। এতে জীবিত ব্যক্তির প্রিয়জনের মৃত্যুকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি হয়, মত ব্যক্তির প্রতি ক্রোধের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়, তার চিহ্নগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টায় থাকে।

মানসিক রোগ নির্ণয়ের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ DSM-5 এ অস্বভাবী এসব মনোবেদনাকে একত্রিতভাবে ‘পারসিসটেন্ট কমপ্লেক্স বিরিভমেন্ট’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং শোক প্রকাশের প্রয়োজনীয় সময়কাল ১২ মাস ধরা হয়েছে।

ক্ষতিকর প্রভাব

  • গবেষণায় দেখা গেছে স্বামী/ স্ত্রী কোনো একজনের মৃ্ত্যুতে তার সঙ্গী বা সঙ্গীনির ৬ মাসের মধ্যে মৃ্ত্যু হওয়ার ঝকি বেড়ে যায়। ৬৫ বছরের কম বয়সী পুরুষ সঙ্গীরা এই ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।
  • হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃ্ত্যু হার সর্বাধিক।
  • এছাড়াও অত্যধিক মানসিক চাপের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে বিরাট সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যকৃতের বিকলাঙ্গতা, ক্যান্সার ও দর্ঘটনা হতে পারে।
  •  শোকে বিহ্বল শতকরা ২০-৩০ ভাগ ব্যক্তি মারাত্মক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারেন।
  •  শোকে কাতর শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাজনিত রোগ, আতঙ্কগ্রস্ততা ও দুর্ঘটনা পরবর্তী অত্যধিক মানসিক চাপজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
  • এছাড়াও তাদের মধ্যে মদ, ঘুমের ঔষধ বা অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায় যা তাদের পড়াশুনা, কর্মক্ষেত্র বা সামাজিক দক্ষতায় মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

শোক কাটিয়ে ওঠার উপায়
প্রিয়জনের মৃ্ত্যুতে মনোবেদনা ও শোক প্রকাশ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অধিকাংশ ব্যক্তি পরিবার, পরিজন,বন্ধু-বান্ধব, মসজিদের ঈমাম, ধর্মযাজক বা শোক পালনের রীতিনীতির মাধ্যমে সহায়তা পেয়ে থাকে। তবে শোকের তীব্রতা ও জটিলতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকম। তাই শোক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিস্থিতি ও সাধারণ নির্দেশনা একটি বিবেচ্য বিষয়।

কাউন্সেলিং
মূল উদ্দেশ্য

  • শোকগ্রস্ত ব্যক্তির মৃ্ত্যুজনিত ক্ষয়ের বাস্তবতা মেনে নেওয়া
  • মর্মযাতনার স্বাভাবিক পর্যায়ের মাধ্যমে কাজ করা
  • প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতেই জীবনের সমন্বয় সাধন করা।

এই উদ্দেশ্যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী তার সাথে প্রিয়জন হারানোর বেদনা, রাগ, অপরাধবোধ, ক্ষতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে তাকে স্বাভাবিক মৃ্ত্যুশোকের ধারা বোঝাতে পারে। তবে ব্যক্তির অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার (অবাস্তব চিন্তা, অনুভূতি, বিভ্রান্তি) ব্যাপারে তাকে পূর্বেই সতর্ক না করলে পরবর্তীতে এটি ভীতিপ্রদ হতে পারে। মৃত ব্যক্তিকে দেখানো এবং তার জিনিসপত্র দূরে রাখার মাধ্যমে এই রূপান্তরটি ত্বরান্বিত হয় এবং এতে তাকে সহায়তা করতে হবে। বাস্তবিক সমস্যা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ, তা হতে পারে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা সংক্রান্ত, অর্থনৈতিক সাহায্য বা বিধবা মহিলার ছোটো শিশুর দেখাশুনা সংক্রান্ত ইত্যাদি।

সময়ের পরিক্রমায় শোক খানিকটা ফিকে হয়ে আসলে শোকগ্রস্ত ব্যক্তিকে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোতে, প্রিয়জনের সঙ্গে কাটানো স্মৃতি রোমন্থনে এবং তার রেখে যাওয়া ইতিবাচক কাজ বা ইচ্ছার ভার গ্রহণে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

ঔষধ
শোক প্রকাশের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে গভীর ঘমের জন্য কিছু দিন কম ডোজে ঘুমের ঔষধ দেয়া যেতে পারে যা ব্যক্তির অস্থিরতা লাঘবে সাহায্য করে। যদি ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতার সমস্যা ও অস্বাভাবিক শোক প্রকট আকারে দেখা যায় তাহলে বিষণ্ণতা নিরোধী ঔষধ ভালো সাহায্য করে।

সাইকোথেরাপি
শোক প্রকাশের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় দুই ধরনের সাইকোথেরাপি কার্যকরী ভমিকা পালন করে।

  • ডাইনামিক সাইকোথেরাপি
  •  গ্রিফ থেরাপি
    এটি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে নিয়মিত ও পরিকল্পিত একটি বৈঠক। এতে অস্বভাবী শোকে বিহ্বল ব্যক্তির শোক ধাপে ধাপে হ্রাসের চেষ্টা করা হয়।

মনোবিজ্ঞানী সিমন হাস্লামায়ারের মতে, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ও ইন্টারপারসোনাল থেরাপির সমন্বয়ে প্রিয়জন বিয়োগ এবং তার জীবনের ইতিবাচক- নেতিবাচক  ‍দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হয়। যদি কারো চিন্তাভাবনা ভলভাবে অভিযোজিত হয়ে থাকে তাহলে তা পুনর্গঠনের মাধ্যমে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। গ্রুপ থেরাপির কার্যকারিতা লক্ষণীয়।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleকরোনায় সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ এর স্বামীর মৃত্যু
Next articleলকডাউনে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় তরুণরা নিঃসঙ্গতায় ভুগছে বেশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here