মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর হলো ভালোবাসা। ফ্রয়েড যদিও বলতেন ভালোবাসার আড়ালে আছে সেক্সুয়্যাল ডিজায়ার বা যৌনাকাঙ্ক্ষা। ভালোবাসা তাই এক রকম স্বার্থপরতা। কিন্তু এরিখ ফ্রম তা মানতে রাজি নন। তিনি ভালোবাসা বলতে বোঝেন যত এবং দেয়ার একটি বিষয়। সত্যি কথা বলতে ভালোবাসাকে একেকজন একেকভাবে দেখেছেন। আর ভালোবাসাও একেকজনের কাছে একেকভাবে ধরা দিয়েছে। কেউ ভালোবাসতে গিয়ে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, আবার কেউ দৈহিক প্রয়োজন থেকে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। সম্পর্কের মূল লক্ষ্য থাকে ঘনিষ্ঠ হওয়া। ঘনিষ্ঠতা মানেই একাকিত্বের অবসান। এই ঘনিষ্ঠতা বা ইনটিম্যাসি কয়েকটা ধাপে আসে। কগনেটিভ বা চিন্তাচেতনার জগতে একটা মিল বা ঐক্য তৈরি হয়। এটাকে চেতনার পারস্পরিক নিভর্রশীলতাও বলা যায়।
এই স্তরে পরস্পরের কথাবার্তা, কথা বলার বিশেষ ধরন, পোশাক-পরিচ্ছদের স্টাইল, ভালোলাগা কিছু বিষয় পরস্পর গ্রহণ করে ফেলে। দেখা গেল আপনি যার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছেন তার বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ আপনি নিজের অজান্তেই বলে ফেলছেন ঠিক তার মতো করে। তার কোনো কোনো আচরণ আপনি নিজের অজান্তেই করে চলছেন। এরপর আসে ভালোবাসার আবেগীয় স্তর। পরস্পরের মধ্যে ভালোলাগা, খারাপ লাগার ভাব বিনিময়। আবেগ বায়বীয়। এই বায়বীয় আবেগকে স্পর্শযোগ্য করতে শরীরের প্রয়োজন হয়। ভালোবাসাপূর্ণ স্পর্শ তাই সব সময় যে যৌন আবেদন পূর্ণ হবে এমন নয়। যাকে বলা হয় নন-সেক্সুয়াল অ্যাফেক্টিভ টাচ- হুবহু বাংলা করলে দাঁড়ায়, অযৌন-স্নেহময় স্পর্শ। হাতে হাত রাখা, জড়িয়ে ধরা বা আলিঙ্গন করা, পায়ে পায়ে স্পর্শ করা এসবই হলো নন-সেক্সুয়াল অ্যাফেক্টিভ টাচ।
ভালোবাসা যখন এভাবে এগোতে থাকে, যৌন মিলনের বিষয়টা সে ক্ষেত্রে চলে আসে শারীরিক স্পর্শের পূর্ণতা নিয়ে। পরিপূর্ণ ভালোবাসা বা কনজিউমেট লাভ আসে ইন্টিম্যাসির পথ ধরে। তাহলে ইন্টিম্যাসি বা ঘনিষ্ঠতার পর্ব যার স্তরগুলো হলো- কগনেটিভ শেয়ারিং, আবেগীয় বা অ্যাফেক্টিভ শেয়ারিং, শারীরিক বা ফিজিক্যাল শেয়ারিং। এই ফিজিক্যাল শেয়ারিংই আবার দুটি পর্বে হয়। ননসেক্সুয়াল এবং সেক্সুয়াল। এভাবেই ভালোবাসায় মন ও শরীর দুটোই জড়িয়ে পড়ে। তবে সব সময় যে মন থেকেই শুরু হয় তা নয়। শরীর থেকেও শুরু হতে পারে। তাই সম্পর্ক আমরা তখনই বলি, যখন পরস্পরের আচরণের ওপর নির্ভর করে দু’জনের আচরণের প্রত্যাশা বদলে যেতে থাকে এবং পাশাপাশি তাদের ঘনিষ্ঠতারও পরিবর্তন হয়। ঘনিষ্ঠতার সূচনা হয় ‘দু’জন যুক্ত আছি’ পরস্পরের সঙ্গে এমন একটা অনুভব করা থেকে।
প্রশ্ন থাকে ভালোবাসা তাহলে কী? এটা কি একটা তীব্র আবেগ? নাকি পরস্পরের ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হওয়ার চর্চা? নাকি পরস্পরের কাছে দু’জনের সুখে-দুঃখে এক সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি? এক দেখাতেই প্রেমে পড়ার অনুভূতি যার হয়েছে সে জানে তীব্র আবেগ বা প্যাশন কী? ভীষণ রকমের এক আকর্ষণ বোধ করা। মনের মধ্যে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে এই আবেগ। যে কারণে সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ভালোলাগা ওই মানুষটির কাছে যেতে চায় মন। শুধু প্যাশনের ওপর ভিত্তি করে যে ভালোবাসা তাকে বলা হয় ইনফ্যাচুয়েশন। এই ইনফ্যাচুয়েশন যৌন কামনা থেকে ভিন্ন। যৌন কামনা বা লাস্টের ক্ষেত্রে যৌন সম্ভোগের ইচ্ছা জাগে- যৌন উত্তেজক ছবি দেখলে বা কিছু পড়লে যেমন হয়। কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশনের ক্ষেত্রে ইচ্ছা জাগে কাছে পাওয়ার। সময়কে উপভোগ করার। তীব্র আবেগের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা যুক্ত হয় তখন আমরা যে ভালোবাসার স্বাদ পাই, তা-ই হলো রোম্যান্টিক লাভ। ঘনিষ্ঠতা মনের চিন্তা আর আবেগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে তখন তাকে বলা হয় প্লেটোনিক লাভ।
অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে কগনেটিভ শেয়ারিং এবং অ্যাফেক্টিভ শেয়ারিং হয়। কখনো কখনো ভালোবাসা পূর্ণ আবেগময় স্পর্শও হয়। কিন্তু দু’জনের মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক হয় না। তাই ফ্রয়েডীয় মতবাদ এই ক্ষেত্রে এক অর্থে খাটে না। রোম্যান্টিক ভালোবাসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে প্রতিশ্রুতি নেই। তীব্র আকর্ষণ ও ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি না থাকাতে বাস্তবতা এখানে কম মোকাবেলা করতে হয়। প্রতিশ্রুতি মানেই সিদ্ধান্ত। বাস্তবতা মেনে সুেখ-দুঃখে এক সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত। ভালোবাসা ছাড়াও সে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। পাত্র-পাত্রীর পছন্দে নয়। পরিবারের সিদ্ধান্তকে মুখ্য করে যে বিয়ে হয়, সেখানে দু’জনের সম্পর্ক কিন্ত প্রথমটায় ভালোবাসা ছাড়াই শুরু হয় শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে। তারপর দু’জনের মধ্যে আবেগ তৈরি হলে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে প্রেম ঘনীভূত হয়।