আগামীকাল জীবনে প্রথম স্কুলে যাবে বলে রাতভর তুলতুলের সে কী উত্তেজনা! মা বাবাও কিছুটা উত্তেজিত। সেই সঙ্গে কিছুতা উদ্বিগ্নও বটে, তুলতুল কি স্কুলে মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? নাকি কান্না করবে? আশঙ্কা সত্য হলো। সে স্কুলের গেটের ভেতরে কিছুতেই মাকে ছাড়া যাবে না। একসময় মা সেদিনের জন্য রণে ভঙ্গ দিলেন।
বেশ ক’দিন ধরেই অন্তু স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুলের সময় এগিয়ে এলেই তার হয় মাথা ব্যথা, না হয় পেট ব্যথা কিংবা অন্য কোনো শারীরিক কষ্টের কথা বলে। অথচ কয়েকদিন আগেও স্কুল-পড়াশোনা নিয়ে অন্তুকে কিছু বলতে হতো না।
উপরের দুটি ঘটনার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন হলেও মলূ বিষয় এক। বিশ্বব্যাপী তুলতুল বা অন্তুদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ দুই শিশুর ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তাকে সহজ ভাষায় বলা হয় স্কুল ফোবিয়া বা স্কুলভীতি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২-৫% শিশু স্কুলভীতিতে ভোগে ((Marry Wimmer, 2010)। স্কুল ফোবিয়া বা স্কুলভীতি বলতে আমরা স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে শিশুর ক্রমাগত এবং অযৌক্তিক ভয়কে বুঝি। এটির সমার্থক আরো কিছু শব্দও ব্যবহার করে থাকি, যেমন- স্কুল প্রত্যাখ্যান/এড়িয়ে যাওয়া।
ঝুঁকিপূর্ণ কারা?
ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব বাচ্চাই কখনো না কখনো, কোনো না কোনো কারণে স্কুল কামাই দেয়। তবে এ ধরনের বাচ্চারা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়াই প্রায়ই স্কুলে যায় না। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত :
- যারা মা-বাবা অথবা পরিচর্যাকারীর সঙ্গ অনেক বেশি চায়।
- যারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
- যারা একটু বেশি সংবেদনশীল অর্থাৎ যারা তাদের আবেগগুলো মানিয়ে নিতে সক্ষম নয়, তারা সহজে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমনকি স্কুলে
- যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও শারীরিকভাবে অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। ১৮-২৪মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব; অতি উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের সন্তানরা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে। ফলে স্কুলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না।
- দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে এমন।
- পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান।
লক্ষণ:
শারীরিক বা মানসিক অথবা দুটিই থাকতে পারে। শারীরিক লক্ষণগুলোর মধ্যে বেশি দেখা যায়- ঘন ঘন পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি করে দেয়া, বার বার বাথরুমে যাওয়া, মাথা ব্যথা ইত্যাদি। মানসিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্কুলে যাওয়ার সময় মা-বাবাকে বা অন্য কাউকে আঁকড়ে ধরে রাখা, অতিরিক্ত মেজাজ দেখানো অথবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়া। অতিরিক্ত অন্ধকারভীতি অথবা একা রুমে ভয় পাওয়া, ঘুমাতে সমস্যা কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখা। স্কুল, কল্পিত ভয়ঙ্কর কোনো প্রাণী, দৈত্য- এসব নিয়ে অনেক ভয়। সারাক্ষণ নিজের বা অন্যদের নিরাপত্তা নিয়ে অহেতুক উদ্বেগ।
কেন এমনটি হয়?
- মূলত বিচ্ছেদজনিত উদ্বেগ ((separation anxiety), পরিবেশনাজনিত উদ্বেগ (Performance anxiety) এবং সামাজিক মেলামেশাজনিত উদ্বেগই (social anxiety) মুখ্য।
- শিশুর স্কুলভীতির জন্য স্কুল বা বাসা অথবা উভয় জায়গার পরিবেশের প্রভাব থাকতে পারে। আবার সবার মধ্যে একই লক্ষণ থাকে না।
বাসার পরিবেশ:
- মা-বাবার অখন্ড মনোযোগ পেলে আলাদা থাকার ভয়ে উদ্বেগ তৈরি হয় (separation anxiety)।
- বাসায় কোনো নিয়ম-কানুন না থাকলে, যেমনইচ্ছামতো খেলা, টিভি দেখা, ভিডিও গেম খেলা ইত্যাদির সুযোগ পেলে।
- অনেক সময় নিরাপত্তার শঙ্কায় ভোগা অভিভাবক বাচ্চা কল্পিত ভয়ে স্কুলে যেতে না চাইলে তাতেও সায় দেন।
- বাসায় আসন্ন কোনো বিপদের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন থাকা।
- চারপাশে ঘটে যাওয়া কোনো প্রাকৃতিক (ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি) অথবা মানব সৃষ্ট সহিংসতা।
- দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে পিছিয়ে পড়ার ভয়।
স্কুলের পরিবেশ:
- স্কুলের পড়াশোনা জটিল লাগলে।
- কারো কারো বোঝার বা শেখার ক্ষমতা অন্যদের থেকে কম থাকতে পারে। ফলে তারা ক্লাসের মল্যূায়ন পরীক্ষাসহ অন্যান্য বড়
- পরীক্ষায়ও খারাপ ফল করতে পারে।
- শিক্ষক বা ক্লাসমেটদের থেকে তির্যক কিংবা অপমানজনক মন্তব্য শোনা।
- শিক্ষকদের থেকে কোনো কারণে শারীরিক শাস্তি পাওয়া।
- স্কুলে অথবা স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে শারীরিক অথবা মানসিক উৎপীড়নের শিকার হলে। অন্য স্কুল থেকে নতুন স্কুলে এলে।
- পর্যাপ্ত আলো-বাতাসবিহীন ক্লাস রুম।
- বাথরুমের সুব্যবস্থা না থাকলে।
- হাতের লেখা খারাপ বা উচ্চারণগত সমস্যার কারণেও অনেক শিশু উপহাসের শিকার হয়। কেউ অতিরিক্ত দক্ষতা (সাংস্কৃতিক) না থাকলেও হীনমন্যতায় ভোগে।
- পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারার দুশ্চিন্তা।
- স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো কার্যক্রমে ভীতি; যেমন- গান, খেলা, অ্যাসেম্বলি, শরীরচর্চা ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপনা:
উল্লেখিত সমস্যাগুলো সাধারণত স্বল্পমেয়াদি হয়। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের মান খারাপ হয়। সমবয়সীদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারবে না এবং এরা বন্ধুত্ব তৈরিতে অন্যদের চেয়ে কম পারদর্শী হয়। বড় হলেও এসব শিশুর মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্কজনিত রোগের আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়া অন্যান্য মানসিক রোগও হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সন্তানকে পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া নিশ্চিত করা। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ফলপ্রসূ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন মাবাবা এবং শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াস। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে।
অভিভাবকের করণীয়:
- প্রথমে বাচ্চাকে আদর দিয়ে ও ভালো কথা বলে বুঝিয়ে দিন আপনি তার সঙ্গে আছেন। তারপর কারণটি খুঁজে বের করুন।
- অন্য কোনো ধরনের মানসিক রোগ আছে কিনা তা যাচাই করুন।
- যদি দীর্ঘদিনের কোনো শারীরিক অসুস্থতা থাকে, তবে আবারো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে।
- বাচ্চার কাছ থেকে স্কুলের কথা শুনতে হবে এবং ভয়ের কোনো কারণ পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে।
- সম্ভাব্য কারণ অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করা।
- ক্লাস শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলা জরুরি।
- সম্ভব হলে স্কুলে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা।
- প্রয়োজনে বাসার পরিবেশে কিছু পরিবর্তন করতে হবে, যাতে বাচ্চা স্কুলে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারে।
- ধীরে ধীরে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে হবে (Graded exposure)। প্রতিদিন একটু একটু করে আগের চেয়ে স্কুলের বেশি কাছে যাবে।
- যখন স্কুলের সময় তখন বাড়িতে কোনো মজা/আনন্দ অনুষ্ঠান করা যাবে না।
- যার সঙ্গ বেশি পছন্দ, সম্ভব হলে তার সঙ্গে স্কুলে পাঠাতে হবে।
- অন্য বাচ্চাদের সঙ্গেও পাঠানো যায়।
- উৎসাহব্যঞ্জক বই পড়ানো যায়।
- স্কুলের পরিবেশ অভিনয় করে দেখাতে বলা যায়।
- স্কুল বিষয়ক অন্যান্য কাজে অংশ নেয়া যেতে পারে।
- শিথিলায়নের চর্চা করতে দেয়া যায়।
- পারিবারিক কোনো ইস্যু থাকলে তা যথাযথ উপায়ে সমাধান করতে হবে।
বিদ্যালয়ের করণীয়:
- প্রথমে শিক্ষক/পরামর্শদাতা এবং শিশুর মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
- দরজায় একজন স্কুলকর্মী/শিক্ষক দাঁড়িয়ে থেকে শিশু ও অভিভাবককে অভিবাদন জানিয়ে তারপর শিশুটিকে সঙ্গে করে ক্লাসরুমে নিয়ে যাবে।
- বাচ্চার সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনতে হবে এবং চর্চা করার সুযোগ দিতে হবে।
- তার পছন্দ এবং অপছন্দের কাজগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
- ছাত্র-ছাত্রীরা কোনোরকম শারীরিক অথবা মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে।
- কোনো বন্ধুভাবাপন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।
- শিশুর শিক্ষাগত দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে তাকে কাজ দিতে হবে।
- যদি কারো বয়স অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তা কম থাকে, তবে তার জন্য বিশেষায়িত শিক্ষার চিন্তা করতে হবে।
- ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন।
এরপরও স্কুলভীতি থেকে গেলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। মনে রাখতে হবে জোর না খাটিয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করলে অবশ্যই সফল হওয়া সম্ভব।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত।