শিশু শিক্ষা : অপরিণত মনে বাড়তি চাপ

মানুষ বড় হতে হতে বিভিন্ন কিছু শেখে। এই শিক্ষার কারণ, প্রয়োজন বা পদ্ধতিও হয় বিভিন্ন। কেউ দেখতে দেখতে শেখে, কেউ ঠেকতে ঠেকতে শেখে। কেউ আবার ঘটা করে বা আড়ম্বর করে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে শেখে। কোনো কোনো শিক্ষার ব্যবহারিক দিক থাকে, কোনোটা আবার এমনিতেই শিখতে হয়। শিক্ষার কারণ যেমন সবার ক্ষেত্রে সমান নয়, তেমনি শিক্ষার পদ্ধতি বা প্রয়োজনও সবার জন্য এক নয়। কেউ হয়তো নিরেট জীবনের প্রয়োজনে বা জীবনে টিকে থাকার প্রয়োজনে শিখছে। কেউ আবার বড় কিংবা ছোট কোনো শখ মেটানোর জন্য শিখছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে দেখতে, ঠেকতে ঠেকতে মানুষের যে শিক্ষা হয়, সেটির জন্য তেমন নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা কাঠামোর প্রয়োজন হয় না। যে যেখানে, যেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সেখান থেকেই ধীরে ধীরে একটু একটু করে শিখে নিচ্ছে। কিন্তু পদ্ধতিগত শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই শিক্ষাকাঠামো তৈরি করে। কোন বয়সে, কখন, কী কী করতে হবে, কী কী পড়তে হবে, এসব অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-ভাবনা করেই তৈরি করা হয়। কিন্তু আজকাল কেমন যেন; সবকিছুতে গোলমাল লেগে গেছে। যার সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লেগেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষায়, শিক্ষার্থীদের ওপর।
প্রায় প্রতিদিনই চেম্বারে কোনো না কোনো অভিভাবক আসেন তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলে কিংবা মেয়েটিকে নিয়ে। কেউ কেউ সরাসরি আসেন আবার কেউ কেউ অন্য কোনো ডাক্তারের কাছ থেকে রেফার্ড হয়েও আসেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পেট ব্যথা, শ্বাস কষ্ট, মাথা ব্যথা, বুক ব্যথা নিয়ে। যার শারীরিক বা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছুই পাওয়া যায় না। অনেক শিশু আবার এমন কিছু উপসর্গ নিয়ে হাজির হয় যে, অভিভাবকরা চরম মাত্রায় বিপর্যস্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে যান বা ভয় পান। অনেক শিশুকে এসব কারণে হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়। এমন একটি গল্প এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।
‘বেশ মন খারাপ করা চেহারা নিয়েই আমার চেম্বারে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা। পেছনে ১০-১১ বছরের মেয়েকে প্রায় কোলে করে হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকলেন আরেক ভদ্রলোক। কথা শুরু করতেই বোঝা গেল তারা মেয়েটির মা-বাবা। পেছনে আরো ৪-৫ জন আত্মীয়-স্বজনের উদ্বিগ্ন মুখ। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মা গরগর করে বলে চললেন, গত ৮-৯ দিন ধরে হঠাৎ করেই মেয়ে আমার হাঁটতে পারছে না। এর মধ্যে অনেক ডাক্তার দেখিয়ে ফেলেছি, কেউ কিছু ধরতে পারছে না। অনেক অনেক পরীক্ষা করা হয়ে গেছে, পরীক্ষায়ও কিছু আসছে না। আউটডোর থেকে বলেছে ভর্তি করাতে হবে, আমরা আপনার রুমে সরাসরি চলে এসেছি বিষয়টি কী বোঝার জন্য।’ এতক্ষণ কথা বলে ভদ্রমহিলা থামলেন। মেয়েটিকে পাশের বিছানায় শোয়ানো হলো। গত কয়েক দিনের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ এবং ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখলাম। তারপর মেয়েটির সঙ্গে আলাপ- তোমার নাম কী, অত্যন্ত নিচু গলায় নাম বলল। তুমি কোন ক্লাসে পড়, ক্লাস ফাইভে। তুমি কেমন আছো, কথা বলছে না। তোমার মন কেমন, কথা বলছে না। তোমাদের বাসা কোথায়, কথা বলছে না। একটু চুপচাপ সময় দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বললাম, কাঁদছো কেন? মেয়েটি তখনো কাঁদছে, কথা বলছে না। মা আবার বলে চলেছেন, ‘আমার মেয়ে খুব ভালো ছাত্রী। সব নিজে নিজে করে, কোনোদিন কোনো বড় অসুখ-বিসুখ হয়নি। স্কুলে টিচাররা ওকে খুব পছন্দ করে।’ ভদ্রমহিলার কথার ফাঁকেই আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোন স্কুলে পড়। মেয়েটি চুপচাপ। মা-বাবা দু’জনই মেয়েকে বলছেন, ‘বলো বলো তোমার স্কুলের নাম বলো’, মেয়েটি কাঁদছে।
ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের পরিচয় জানলাম, কোথায় থাকেন শুনলাম, মেয়েটির স্কুলের নামও জানলাম। জানলাম সামনে মেয়েটির পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা। ভালো ছাত্রী, ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরেই পড়তে যায়। ৯টায় কোচিং। কোচিং শেষে স্কুল শুরু।
আড়াইটা পর্যন্ত সেখানেই। বাসা থেকে খাবার যায় স্কুলে। খাওয়া সেরে আবার স্কুলের কোচিং। ৫টার দিকে বাসায় ফিরে একটু রেস্ট। সন্ধ্যায় বাসায় টিচার আসে। টিচার ফিরে যাওয়ার পর রাতের খাবার খেয়ে একটু টিভি দেখা, আবার পড়া। পড়তে পড়তে ঘুম। জানলাম ওদের ক্লাসের সবারই প্রায় একই রকম রুটিন। কেবল ওদের ক্লাসেরই না, বরং বলা ভালো, সারাদেশেই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় একইরকম অবস্থা। টিচারদের চাপ, ভালো রেজাল্ট করার চাপ, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চাপ। মা-বাবার কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা কতক্ষণ কাজ করেন? এই মেয়েটিকে আপনারা সারাটা দিন কাজ করান। তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা বললেন। বললেন, ‘কী করব, সামনে পরীক্ষা।’
প্রায়ই আজকাল আমাদেরকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বন্ধের দিনে বিশেষ বিশেষ ক্লাসের কথাও বলে কেউ কেউ। নাচ শিখতে যাওয়া, গান শিখতে যাওয়া, ছবি আঁকতে যাওয়া- কত কী। আরবি পড়ার জন্য হুজুরও আসেন কারো কারো বাসায়। শুনে শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই তো প্রয়োজনীয়। কোনটা বাদ দেবে। স্কুলের পড়ার রুটিন, নাচ, গান, ছবি আঁকা, আরবি পড়া। সবই তো দরকার। সেদিন দেখলাম একটা মেয়ে জেলা শহরের স্কুলে পড়ে কিন্তু ঢাকায় কোচিং করে। স্কুলে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। অনেকেই নাকি স্কুল বাদ দিয়ে এমন কোচিং করে। আরেকজনের কাছ থেকে জানা গেল স্কুলের টিচারদের কাছে কোচিং না করলে নাকি বিভিন্ন রকমের অসুবিধায় পড়তে হয়। নিজেরাই অসহায় হয়ে যাই। কী চিকিৎসা হবে ওদের? বলি, বিকেলটা তো বাদ রাখতে পারেন। কেউ কেউ আমাদের কথা শুনে বিকেলটা ছেলে-মেয়েদের পড়া থেকে বিরত রাখেন। তাতে ফলও পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে তাদের অনেকের সমস্যাই কমে আসে।
অনেকেই আবার বিকেলের পড়া বাদ দিলেও ঘরেই বসে থাকে। যাবে কোথায়? করবে কী? অদ্ভুত সঙ্কট আমাদেরকেও পেয়ে বসে। কী হবে সমাধান! কোনো কোনো অভিভাবককে এসব কথা বলার পর দেখা গেছে, দ্বিতীয়বার আর আমাদের কাছে আসে না। এসব কথা বা পদ্ধতি তাদের কাছে ঠিক পছন্দ নয়। অনেকে বলেও বসেন, আসলাম বাচ্চার পেটের ব্যথার কারণে আর আপনি বলছেন পড়া বাদ দিতে! এসব পেটের ব্যথা বা মাথা ব্যথা যে অপরিণত মনের ওপর বাড়তি চাপের কারণে হয়, অনেক সময় সেটা বোঝানোও সম্ভব হয় না।
সমস্যাটিই যেন আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে, আমাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলেছে। আগে কি এমন ছিল? সারা পৃথিবীতেই কি একই অবস্থা? দিনকে দিন এমন সমস্যা আর রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণা হয় না। এই গবেষণাটি কেউ পরিচালনা করে দেখতে পারেন। শিশু বিশেষজ্ঞদের কাছে আরো ভালো তথ্য পাওয়া যাবে। ওপরের মেয়েটির জন্য এসব চাপ শুধু চাপ হিসেবেই থাকেনি। মেয়েটিকে ‘চাইল্ডহুড ডিপ্রেশন’ বা শৈশবকালীন বিষণ্নতায় পেয়ে বসেছিল। মেয়েটির মা-বাবাকে সেটি বোঝানো সম্ভব হয়েছিল। তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়েছেন। পরবর্তীতে মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে, হাসতে হাসতেই চেম্বারে এসেছে। তার হাসিমাখা মুখ এখনো মনে পড়ছে।
বুঝে না বুঝে তৈরি করা এমন চাপে কি আমাদের গোটা ভবিষ্যৎ পঙ্গু হয়ে যাবে? এর সমাধানের দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে। পদ্ধতিগত শিক্ষাব্যবস্থায় এমন পদ্ধতি যোগ করতে হবে, যাতে করে এসব শিশুরা পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা বা পঙ্গুত্ব নিয়ে বড় না হয়। শিক্ষা মানুষের প্রয়োজনের জন্য। পদ্ধতিগত শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করার জন্যই তৈরি। সেই শিক্ষার চাপই যদি সহ্যের বাইরে চলে যায়, তবে শিক্ষা দিয়ে কী হবে? কাকে দিয়ে, কোন বয়সে কতটুকু করা যায় এসব খুব সাধারণ হিসাবের বিষয়। কিন্তু অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা আমাদেরকে অসুস্থ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

Previous article'মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অত্যান্ত মানবিক কাজ'
Next articleতরুণদের প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক রোগে ভুগছে
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here