দীর্ঘমেয়াদি রোগীদের জন্য কর্মস্থলে কেমন পরিবেশ দরকার?

0
35

ডা. দেবদুলাল রায় 
রেসিডেন্ট, ফেইজ বি, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

কবি নজরুলের ভাষায় “থাকুক, অভাব দারিদ্র্য, ঋণ, রোগ-শোক, লাঞ্ছনা- যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না। ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক, নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুঃখ।”

মানুষের জীবন নিয়ত সংগ্রামের। বেঁচে থাকার জন্য, প্রতিনিয়ত চলে সংগ্রাম। এই সংগ্রাম আরো কঠিন হয় যখন মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। রোগ-ব্যাধি প্রভাবিত করে মানুষের জীবনী শক্তিকে। সীমিত শক্তি নিয়ে অসীম সংগ্রামের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খায়। সাথে থাকে কর্মজীবনে অসমাপ্ত কাজের চোখ রাঙানি, সহকর্মীদের বিদ্রুপ। সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকে আগাম অবসরকেই মেনে নেয় সম্মানজনক সমাধান হিসেবে। আর যাদের উপায়ান্তর থাকে না, তারা সীমিত সাধ্যের সবটুকু নিংড়ে লড়তে থাকে। হয়ত অসম এই যুদ্ধে বেঁচে থাকে, কিন্তু বেঁচে থাকার আনন্দটুকু হয় নির্বাসিত কিন্তু কেন এমনটা ঘটে? রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া একটি চিরন্তন নিয়ম। বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত চাপ, দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, এমন সব নানাবিধ কারণে বরং রোগাক্রান্ত হবার হার অতীত সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার একটি উল্লেখযোগ্য হার দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এরমধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, বিষণ্ণতা, ওসিডি, বাতরোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সময় বাড়ার সাথে এই দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর প্রকোপ ক্রমেই বেড়ে চলছে। ইউরোপের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ২৮ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত, যা ২০৬০ সাল নাগাদ শতকরা ৫২ শতাংশে উত্তীর্ণ হবে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী কর্ম-পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমবে, ব্যাহত হবে অর্থনীতি, বাধাগ্রস্ত হবে দেশের উন্নয়ন। দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলি একেকটা একেক প্রকৃতির হয়ে থাকে। বাতরোগে আক্রান্ত রোগীরা ব্যথায় কাতর থাকে। কখনো কখনো নিদারুণ ব্যথার প্রকোপে রাতে ভালো ঘুম হয় না, ফলে বাতরোগীদের সকাল শুরু হয় অবসন্নতা দিয়ে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাদের ব্যথার প্রকোপ ও অবসন্নতা কিছুটা হ্রাস পায়।

তাই বাতরোগীদের জন্য অফিসের শুরুতেই অধিক চাপের কাজ যতটা সম্ভব না দিয়ে কম চাপযুক্ত কাজে নিয়োগ করা প্রয়োজন। তাদের চাপযুক্ত কাজগুলো একটু পরের দিকে রাখাই সমীচিন। এছাড়াও একনাগাড়ে বসে না থেকে দেড় দুই ঘণ্টা পর পর মিনিট দশেকের জন্য একটু হাঁটা বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের সুযোগ রাখলে তাতে বাতরোগীদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বহুমূত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। এরজন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। বহুমুত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেককেই দিনে একাধিকবার ওষুধ সেবন করতে হয়, কিংবা ইনসুলিন নিতে হয়। বারবার হালকা খেতে হয়। সুতরাং তাদের সময়মতো ওষুধ সেবনের সুযোগ করে দেওয়া এবং ঔষধ সেবনের আগে-পরে খাবার গ্রহণের সুব্যবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন। বহুমূত্র ও স্ট্রোক পরবর্তী রোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হচ্ছে স্কুলে যাওয়া। তাই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভুলে যাওয়া নিয়ে যেন দপ্তরের কাজের কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য তাঁদের নোট রাখতে উদ্বুদ্ধ করা এবং পাশাপাশি সহকর্মীরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। মনোরোগ: যেমন-বিষন্নায় আক্রান্ত ব্যক্তির কাজের উৎসাহ কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে সহমর্মিতার সাথে সহযোগিতা করার পাশাপাশি যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। সর্বোপরি আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য সবার আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কটূক্তি, তাচ্ছিল্য বা অতিরিক্ত চাপ ব্যক্তির বিষণ্ণতাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি ম্যানিক ফেজ-এ থাকাকালীন সময়ে কিছুটা অসংলগ্ন আচরণ করতে পারে। রেগে যাওয়া, অতিরিক্ত কথা বলা-সহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের সাথে তর্ক এড়িয়ে কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। ক্ষেত্রভেদে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও মূলত সকল দীর্ঘমেয়াদি রোগীদের দাপ্তরিক পরিবেশ হতে হবে আরামদায়ক! যেন কাজে এসে দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি অস্বস্তিতে না ভোগেন। বেশির ভাগ দীর্ঘমেয়াদি রোগের সাথে মানসিক চাপের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। মানসিক চাপে প্রায় সব রোগই বেড়ে যায়। তাই কর্মস্থলে যেন মাত্রাতিরিক্ত চাপ না থাকে। সহকর্মীদের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়াও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহকর্মীদের সবার মাঝে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, একে অপরকে সহযোগিতার মানসিকতা থাকে তাহলে কাজের গতি ত্বরান্বিত হয়। দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। সেক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়াও গুরুতর অসুস্থ হলে তাদের অনুপস্থিতির বিষয়টি মার্জনা করা এবং অনুপস্থিতিকালীন সময়ে সকলে মিলে অসুস্থ ব্যক্তির দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে অসুস্থ সহকর্মীকে আশ্বস্ত করার মাধ্যমে কর্ম-পরিবেশের প্রভৃত উন্নয়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে অফিস প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিয়মিত স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেওয়া এবং যথাযথ প্রয়োজনে ছুটি মঞ্জুর করা, গুরুতর অসুস্থতার সময়ে দুশ্চিন্তার পারদ না বাড়িয়ে বরং তাকে অশ্বস্ত করার মাধ্যমে কাজের পরিবেশ ও মান দুটোরই উন্নতি সাধন সম্ভব। তবে, অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে কেউ যেন অযৌক্তিক সুবিধা না নিতে পারে সে বিষয়েও অফিস প্রধানকে তৎপর থাকতে হবে।

অনেকেই মনে করেন অসুস্থ ব্যক্তিকে বাড়তি সুবিধা দিলে আখেরে অফিসের কর্ম-পরিবেশ নষ্ট হবে। অন্যান্যরাও তখন বাড়তি সুবিধা নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু অসুস্থতা যেহেতু একটি অনিশ্চিত বিষয় এবং তাতে যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখে সকলকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি রোগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ অর্ধেক জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হবে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর যথাযথ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে, কর্মক্ষেত্রে তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞার শিকার হয়ে অগ্রিম অবসরে যেতে বাধ্য হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগোষ্ঠীর অর্ধেককে উপেক্ষা করে কখনোই উন্নয়নের রথে পাড়ি দেবার স্বপ্ন বাস্তবিক রূপ লাভ করবে না। স্বাচ্ছন্দ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা: এই তিনটি গুণের যথাযথ প্রয়োগ ঘটালেই কর্ম-পরিবেশের উনয়ন করা সম্ভব। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত রোগের কারণে বাড়তি সুবিধা চায় না। তারা চায় কাজ করতে। একটু সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমেই তাদের এই কর্মস্পৃহাকে বাড়ানো সম্ভব।

Previous article“হতাশার মধ্যেই থাকি, চব্বিশ ঘণ্টাই মানসিক চাপে থাকি”
Next articleদেশের ৫৭ শতাংশ তরুণ বিষণ্ণতায় ভুগছেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here