চিন্তিত মুখে অফিসে নিজের ডেস্কে বসে আছে লিটন। গত চার মাস খুব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে। সবকিছুতে মনে হয় জীবাণু লেগে আছে। আশেপাশে কেউ হাঁচি-কাশি দিলে মনে হয় ভয়াবহ জীবাণু তার হাতে-পায়ে লেগে যাচ্ছে, সেখান থেকে তার ভয়ানক অসুখ হবে। সারাক্ষণ হাত ধুতে থাকে, পকেটে করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরছে সে।
বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, যেটুকু বেতন পায় তার বেশিরভাগই এখন খরচ হয়ে যাচ্ছে সাবান আর এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনতে। শুধু নিজে হাত ধোয়া না, বাসায় বাবা-মা আর ছোটো ভাইয়ের সাথে তার চরম রাগারাগি হয়ে যাচ্ছে। চারমাস আগে এই সমস্যা তার ছিল না, কিন্তু তখনও একটা বিক্ষিপ্ত অবস্থা ছিল। একবছর আগে থেকেই মাথার মধ্যে কিছু চিন্তা আসত। ২৬ বছরের জীবনে ধর্ম বিষয়ে কখনো পরিবারের আর সবার চিন্তাভাবনা-নিয়মকানুন নিয়ে তার কোনো প্রশ্ন, সন্দেহ আসেনি, ধার্মিকই বলা যায় তাকে। কিন্তু তখন আল্লাহকে নিয়ে প্রশ্ন আসা শুরু হলো, নামাজে দাঁড়ালেই প্রশ্নগুলো বেশি করে আসত। চোখের সামনে কিছু দৃশ্য আসত যা তার মনকে যন্ত্রণায় পুড়িয়ে দিত। প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করত তার মধ্যে। চিন্তাগুলো, ছবিগুলো আসলে দোয়া পড়ে নিজের গুনাহর জন্য মাফ চাইত।
অনেক ইমাম, হুজুরের সাথে কথা বলে অনেক দোয়ার মাসলা-মাসায়েল নিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করত। সেই সাথে একটা কাজ করতে হতো তাকে। রাস্তাঘাটে, কোনো কাগজে ‘৩’ সংখ্যাটা দেখলেই তাকে সেটার দিকে দুইবার তাকাতেই হবে, না তাকালে ভয় হতো যে ঘরে আগুন লেগে যাবে অথবা কারো বড়ো দুর্ঘটনা হবে।
এই লক্ষণগুলো এখন কিছুটা কম হলেও এগুলোর সাথে যোগ হয়েছে নোংরাময়লার ভয়। বাসায় মা খাবার বেড়ে দিলে সে খেতে পারে না, মাকে দশবার হাত ধোয়ানোর চেষ্টা করেছিল তার প্লেট ধরার আগে, মা রাজি হননি। এই অবস্থায় একদিন তার ছোটোভাই একটা পত্রিকা পড়ে তাকে বলেছিল তার মধ্যে মানসিক সমস্যা আছে, সে যেন মনোরোগের চিকিৎসক দেখায়, এতে ভাইয়ের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া করে সে এবং মা-বাবা তার কাজগুলো মেনে না নেয়ার পেছনে ভাইয়ের মাতব্বরি থাকার অভিযোগও সে করে।
ইদানীং তার এই কষ্টের সাথে যোগ হয়েছে আরেক কষ্ট। বাসায় বাবা-মা বারবার বলছেন ডাক্তারের কাছে যেতে। একজন ডাক্তার বন্ধু তাকে নিয়েও গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। বেশি সাবান ব্যবহারে হাতের চামড়ার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়াতে চর্মরোগের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর উনি হাত বেশিবার ধোয়ার কারণ জানতে চেয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালেন। বন্ধুর ওপর প্রচ রাগ হয়েছিল তার। মনে হচ্ছিল সবাই তার সমস্যাকে তামাশা হিসেবে দেখছে। তবে একদিন বাবা তাকে ডেকে বুঝিয়ে বললেন যে মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে যেতে কোনো অসুবিধা নেই, বাবা পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘একবার গিয়ে দেখো বাবা, বলে দেখ তোমার সমস্যা, তারপর কী বলেন আগে শোন’। লিটন শেষ পর্যন্ত গিয়ে কথা বলে জানতে পারল তার রোগটার নাম অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার এবং রোগটির বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে।
হ্যাঁ, সুধী পাঠক যদি এরকম ধরনের লক্ষণ আপনার বা আপনার পরিবারে, বন্ধুদের মধ্যে দেখেন এবং তাদের জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয় এসব লক্ষলের জন্য তাহলে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার এর বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়-
১। ওষুধ: অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার এর বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসায় এসএসআরআই নামের একটি গ্রুপের ওষুধ সাধারণত দেয়া হয়। কোনোভাবেই এই রোগে ওষুধের গুরুত্ব খাটো করে দেখার উপায় নেই। ওষুধ মস্তিষ্কের যেই রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে গোলমালের জন্য রোগটি হচ্ছে সেই স্থানে কাজ করে। ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে খেতে হয়।
২। সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা : অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার এর বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসায় এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন, কগনিটিভ থেরাপি, মাইন্ডফুলনেস নামে চিকিৎসা দেয়া হয়। এই ধরনের চিকিৎসাগুলো আচরণ পরিবর্তন, চিন্তা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় নিয়ে কাজ করে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করা হয় এক একটি সেশনে। উপসর্গের তীব্রতাভেদে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহও প্রয়োজন হয়। এছাড়া রিলাক্সেশন বা নিজেকে শিথিল করার উপায় শিখতে হয় ওপরের চিকিৎসার অংশ হিসেবে। পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেন), মনোবৈজ্ঞানিক, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট চিকিৎসা শুরু করেন এবং চিকিৎসার ফলাফল তত্ত্বাবধান করেন।
পরিবার এবং নিকটজনদের ভূমিকা : অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার এর রোগীদের পরিবারের সদস্যগণ, বিবাহিত সঙ্গী, বন্ধুবান্ধব ও এই উপসর্গগুলো দ্বারা কষ্ট পান। অনেকসময় রোগী তার নিজের বাধ্যতামূলক আচরণগুলো পরিবারের নিকটজনদেরও করতে বাধ্য করেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের একজন-দুইজন একই আচরণ করাও শুরু করে এবং তাদেরও কষ্ট হয়। তবে এসব ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় পালন করলে রোগী এবং তার নিকটজনেরা উপকৃত হতে পারেন :
১। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার রোগীকে ইতিবাচকভাবে এবং সমর্থন দিয়ে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া। ‘তোমার এটা পাগলামি’, ‘চাইলেই তো বন্ধ করতে পারো’ এসব নেতিবাচক কথা বলা বা ব্যঙ্গবিদ্রুপ না করে ‘কষ্ট হচ্ছে, সেটা কমানোর জন্য’, ‘সাহায্য নিলে ভালো লাগবে’ এরকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া। কোথায় চিকিৎসা করা যায় সেই খোঁজ-খবর দেয়া যায়।
২। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার রোগীসহ পরিবারে একটি ইতিবাচক, শৃঙ্খলার এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ রাখা।
৩। বাধ্যতামূলক আচরণে সায় না দেয়া। এরকম দেখা যায় যে সন্তানের বেশি ধোয়াধুয়ির ব্যাপারে সাহায্য করে যাচ্ছেন মা, স্বামীর বারবার পরীক্ষা করে দেখার আচরণ স্ত্রীও করে যাচ্ছেন কষ্ট করেই। এসব ক্ষেত্রে সম্পর্কে সমস্যা এড়ানোর জন্য করলেও একসময় সম্পর্কে অসুবিধা আসেই।
৪। নিকটজনদের নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে সচেতন থাকা জরুরি, কারণ নিজে ভালো না থেকে অন্যকে সাহায্য করা যায় না। ঠাট্টা তামাশা, লুকিয়ে রাখা, নিজের দিকে না তাকিয়ে বাধ্যতামূলক আচরণের প্রতি সমর্থন না দিয়ে, অন্যদেরকে রোগের জন্য দোষ দেয়া থেকে বিরত থেকে, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে সময় নষ্ট না করে দ্রুত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা শুরু করলে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের উপশম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে