তিন বছর ধরে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত পঞ্চান্ন বছর বয়সী ব্যাংকার জাফরুল্লাহ। খেতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। প্রায় সপ্তাহেই পরিবার বা বন্ধু-সহকর্মীদের নিয়ে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করা ছিল বলতে গেলে তার রুটিন। দৈনন্দিন কাজের মাঝে দুপুরের খাবার বা বিকেলের নাস্তাতেও তিনি ছিলেন বেশ সৌখিন।
কিন্তু তিন বছর ধরে খাবারের ধরন বদলাতে হয়েছে তার। বাসা থেকেই দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। সপ্তাহান্তের রেস্টুরেন্ট বাদ দিতে হচ্ছে। আগে গাড়িতে অফিস যাতায়াত করলেও এখন ফেরার সময়টায় গাড়ি বাদ দিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে ফেরেন। সকালের সুখ-নিদ্রাটাও বাদ গেছে। ভোরে উঠে ঘড়ি ধরে চল্লিশ মিনিট হাঁটেন রোজ ভোরে। তার ওপর প্রতিদিন দু-বেলা ইনসুলিন নিতে সুঁইয়ের খোঁচা। মাস তিনেক ধরে এসব আর করতে ইচ্ছে হচ্ছে না জাফরুল্লাহ সাহেবের। ভোরের হাঁটা বাদ পড়ছে। ইনসুলিন নেয়াতেও অনিয়ম। ব্যাংকের কাজেও উৎসাহ কমে গেছে। নিয়ন্ত্রিত খাবারেও রুচি কমেছে। কমেছে যেন জীবনের প্রতি আগ্রহও। ফলাফল হচ্ছে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে রক্তে গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে গেছে।
সব দেখে-শুনে ডায়াবেটিসের চিকিৎসক জাফরুল্লাহ সাহেবকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করেন। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে শুনে অবাক হলেও চিকিৎসকের পরামর্শমতো গেলেন তিনি। বিস্তারিত শুনে আর পরীক্ষা করে সাইকিয়াট্রিস্ট জানালেন, বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত জাফরুল্লাহ সাহেব। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার পাশাপাশি শুরু হলো বিষণ্ণতা রোগের চিকিৎসা। মাস দুয়েক পর ডায়াবেটিস আবার নিয়ন্ত্রণে জাফরুল্লাহ সাহেবের, নিয়ন্ত্রণে বিষণ্ণতা এবং জীবনরীতিও।
দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার এবং ঝুঁকি নিরোগ মানুষের চেয়ে বেশি। রোগভেদে এ ঝুঁকি দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত। শারীরিক রোগের সঙ্গে মানসিক রোগও নির্ণীত হলে একে Co-morbid ev Co-occurring disorder বা সহ-ঘটমান রোগ বলা হয়। একই ব্যক্তির মাঝে সহ-ঘটমান একাধিক রোগের উপস্থিতি দেখা দিতে পারে দুটি রোগের মধ্যে সরাসরি কারণিক কোনো সংযোগ ছাড়াই। অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক রোগ দুটির মধ্যে সরাসরি কোনো সংযোগ হয়ত নেই বা পাওয়া যাচ্ছে না, ভিন্ন ভিন্ন কারণে একই সময়ে একই ব্যক্তির মাঝে রোগ দুটির উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। আবার, অনেক ক্ষেত্রেই একাধিক রোগের মধ্যে কারণিক সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ একটি রোগের কারণে অন্য রোগটি হয়। হতে পারে মানসিক রোগের কারণে শারীরিক রোগ হয়েছে কিন্তু শারীরিক রোগটি ধরা পড়েছে আগে, মানসিক রোগটি জানা গেছে পরে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে পঞ্চাশ বছর বয়সী ব্যবসায়ী তারিক শামসের কথা যিনি অ্যালকোহলে আসক্ত কিন্তু পরিবার বা ঘনিষ্ঠ কেউ সে কথা জানে না। অ্যালকোহল বা মদে আসক্তির ফলস্বরুপ তার লিভার সিরোসিস হলো। শারীরিক উপসর্গ, লক্ষণ দেখে পরীক্ষার মাধ্যমে তার লিভার বা যকৃতের রোগটি আগে ধরা পড়ল। পরবর্তীতে এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল তার মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোগের কথা। বলা যেতে পারে বিশ বছর বয়সী মডেল অরুণার কথাও। অরুণা কম ওজন এবং অপুষ্টিজনিত শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে নির্ণীত হয় যে, তিনি স্বল্পাহারজনিত কৃশতা বা ‘অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা’ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত, যার ফলে দেখা দিয়েছে শারীরিক জটিলতা।
উল্টোভাবে, শারীরিক রোগের কারণেও হতে পারে মানসিক রোগ। শারীরিক রোগ, এর জটিলতা এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের প্রভাব-যেকোনোভাবে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। ষাট বছর বয়সী গৃহবধূ মনিরা রহমান দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত এবং এ রোগের চিকিৎসায় টানা অনেকদিন স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ নিচ্ছেন। কিছুদিন ধরে তার ভেতর সন্দেহপ্রবণতা, ভ্রান্ত বিশ্বাস, গায়েবি আওয়াজ শোনা প্রভৃতি মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে জীবনে প্রথমবারের মতো।
দীর্ঘদিন নেয়া স্টেরয়েড সাইকোসিস জাতীয় মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে। শারীরিক রোগের সরাসরি মস্তিষ্কে প্রভাব ছাড়াও এর মানসিক ও সামাজিক প্রভাবেও হতে পারে মানসিক রোগ। দীর্ঘমেয়াদি কোনো শারীরিক রোগ ও এর চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ‘সাইকোলজিক্যাল’ বা মানসিক প্রভাব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি একটি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঔষধ সেবন করতে হতে পারে আজীবন। কেবল ঔষধ সেবনই নয়, রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালিতেও আনতে হয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া ব্যক্তির জন্য মানসিক চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিরাময়যোগ্য নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে রোগটি মেনে নেয়া এবং এর বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াও ব্যক্তির মানসিক শক্তির বড়ো পরীক্ষা নেয়।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির মাঝেই বিষণ্ণতা রোগ দেখা দেয়। একইভাবে, ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝেও মানসিক রোগের ঝুঁকি নিরোগ মানুষের চেয়ে বেশি। দীর্ঘমেয়াদি যেসব রোগে কষ্টদায়ক উপসর্গ যেমন : তীব্র ব্যথা, ঘন ঘন বমি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি থাকে এবং রোগীর কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায় বা রোগী চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন, সেসব ক্ষেত্রে মানসিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। শারীরিক কিছু রোগের কারণে কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় বা না থাকায় অনেকেই চাকরিচ্যুত বা কর্মহীন হয়ে পড়েন। বেকারত্ব মানসিক রোগের অন্যতম বড়ো একটি প্রভাবক।
শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে যেসব মানসিক রোগ বেশি দেখা দেয় সেগুলো হচ্ছে-অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা রোগ, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত রোগ। এছাড়াও রোগীদের অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা তীব্র মানসিক চাপজনিত রোগ, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ, মাদকাসক্তি বা দ্রব্য ব্যবহার-জনিত রোগ, ঘুমের সমস্যাজনিত রোগ, সেক্সুয়াল ডিজঅর্ডার বা যৌন রোগ ইত্যাদি রোগও হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে সামগ্রিকভাবেই মানসিক রোগকে গুরুত্ব কম দেয়া হয়। একই ঘটনা ঘটে শারীরিক রোগে আক্রান্তদের মানসিক সমস্যার বেলাতেও।
চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর শারীরিক রোগটি যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়, মানসিক রোগটিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু সহঘটমান মানসিক রোগ শারীরিক রোগটির চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। মানসিক রোগটির চিকিৎসা না করালে শারীরিক রোগের চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে এবং রোগীর জীবনীশক্তিও হ্রাস পায়। যেমন : ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সহঘটমান বিষণ্ণতার চিকিৎসা না করা হলে বিষণ্ণতাজনিত উপসর্গের কারণেই তিনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য আবশ্যিক নিয়ম-কানুন পালনে ব্যর্থ হতে পারেন, খাবার ও ঔষধ সেবনে অনিয়মিত হতে পারেন। ফলে তার শারীরিক রোগটির সঠিক চিকিৎসা ব্যাহত হয়। রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে জীবনাশঙ্কা তৈরি করে।
এসব কারণে, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগে আক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক রোগের পাশাপাশি কোনো মানসিক সমস্যা বা রোগ আছে বা হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন করতে হবে এবং মানসিক রোগ ধরা পড়লে দ্রুত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে