মাদকাসক্তি একটি দীঘর্মেয়াদি মস্তিষ্কের রোগ, কিন্তু অনেকে এই রোগকে স্বল্পমেয়াদী রোগ বা সেকেন্ডারি রোগ মনে করেন। এমনও দেখা যায় অনেকে এখনো এটাকে রোগ হিসেবে না দেখে মনে করেন এটা একটা নৈতিক অবক্ষয় বা নিজেদের তৈরি একটি সমস্যা।
প্রথম মাদক গ্রহণ স্বেচ্ছায় হলেও হলেও সুযোগ পেয়ে কিন্তু ‘সবাই মাদক গ্রহণ করে না অথবা মাদক নেয়ার পরও সবাই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে না। আসলে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীন অনেক বিষয় থাকে যেগুলো মাদক নিতে এবং নেশা চালিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন-বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব, মাদকের সহজলভ্যতা, জেনেটিক ঝুঁকি ইত্যাদি (VATSPUD STUDY)। স্বেচ্ছায় মাদক নেয়া শুরু হলেও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা মাদকের ব্যবহার পরবর্তীতে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, প্রবেশ করেন অন্ধকার জগতে, হয়ে পড়েন মাদকাসক্ত। এই সময় মাদক নেয়াটাই একজন মাদকাসক্তের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দুনিয়ার অন্য কোনো মোহ তাকে এ-পথ থেকে সরাতে পারে না।
মাদক মস্তিষ্কের Mesolimbic Pathway-এর উপর কাজ করে, যেটি মধ্য মস্তিষ্কের খোলস (VTA) থেকে শুরু হয়ে Nucleus Accumbens, Orbito-frontal Cortex, Cingulate Gyrus বিস্তৃত। এই পাথওয়ের আরেক নাম Dopaminergic Reward System কারণ, এটি ডোপামিন নামক নিউরো-কেমিক্যাল নিঃসরণের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীকে আনন্দের অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতি এতই তীব্র যে, মাদকাসক্তের আর অন্যত্র তাকানোর বা অন্য কিছু ভাবার মানসিক তাড়না থাকে না। মজা পাওয়ার সাথে সাথে মাদকের ব্যবহারও বেড়ে যায় (Reinforcement)। মাদকাসক্তের এ পাগলামো থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করার জন্য মস্তিষ্ক তখন স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে কোষের বহিঃবিভাগ থেকে রিসেপ্টর সরিয়ে, রিসেপ্টর এবং ইফেক্টরের কাজে অসহযোগিতা করে এবং সবর্শেষ সৈন্য নিয়োগ করে (Opponent Proces) ডোপামিনের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। নাভের্র জন্য ক্ষতিকারক অতিরিক্ত ডোপামিন তখন Synaptic Cleft এ অলস বসে থেকে নিউরনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। রিসেপ্টরের অভাবে কাজ করতে না পারার কারণে পুরো Reward System অকাযর্কর হয়ে পড়ে। যার ফল পড়ে কগনিটিভ ফাংশান, মোটিভেশন, স্মৃতিশক্তি এবং এক্সিকিউটিভ ফাংশানের ওপর। এতে দেখা যায় একজন রোগী দীঘর্দিন মাদক নেয়ার পরও তার মোটিভেশন Pre-Contemplation Stage (Prosaska & Diclement, 1983, 1992.)-এ থাকে, অর্থাৎ তার ভালো হওয়ার কোনো ইচ্ছাই জাগত্র হয় না।
এই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অভিভাবকগণ এক সময় বাধ্য হয়েই এদেরকে চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠান। যদিও মাদকের চিকিৎসা এবং প্রতিকার সম্পর্কে বেশিরভাগ অভিভাবকেরই কোনো ধারণা থাকে না। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার পরও অনেকের পক্ষে দীঘর্মেয়াদি পরিপূর্ণ চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। যার ফলাফল বারবার মাদকাসক্তি। রোগের ধরনটা সম্পর্কে না বোঝার কারণে অনেকে মনে করেন এটা চিকিৎসার ব্যথর্তা। বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় চিকিৎসা সম্পর্কে তৈরি হয় নেতিবাচক মানসিকতা।
আসলে এক, দুই বা তিন মাস চিকিৎসা করে মাদকাসক্তকে আসক্তিমুক্ত অসম্ভব। এই সময়ের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি চিকিৎসা বা ডিটক্সিফিকেশন করা হয় যার মাধ্যমে রোগীকে শারীরিকভাবে মাদকের প্রভাব থেকে মুক্ত করা সম্ভব। এটা মাদকাসক্তির কোনো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নয়, এটাকে আসলে চিকিৎসার শুরু বা চিকিৎসার প্রথম ধাপ বলা চলে। এরপরে রোগের কারণ পর্যালোচনা করে দীঘর্মেয়াদি ঔষধি চিকিৎসা এবং সাইকোসোশ্যাল চিকিৎসা না দিলে প্রকৃত রোগটা অধরাই থেকে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাদক নেয়া বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্ক তার পূবের্র কাযর্কারিতা ফিরে পায় না এবং মাদকজনিত শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং পেশাগত সমস্যাগুলো রাতারাতি সমাধান হয় না। মাদক মস্তিষ্কের যে অপূরণীয় ক্ষতি করে সেটা ফিরে পেতে দীর্ঘ সময় এমনকি কয়েক বছর লেগে যায়। এ সময় ভালো হওয়ার জন্য মাদকমুক্ত থাকা একান্ত অনিবার্য। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ অথবা ফলোআপে থেকে কমপক্ষে বারো মাস মাদকমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। পুনরায় আসক্তির সম্ভাবনার কারণে একটা দীর্ঘ সময় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চিকিৎসার আওতায় থেকে মস্তিষ্ককে সুস্থ হওয়ার সময় ও সুযোগ দিতে হবে এবং কম্পালসিভ ড্রাগ নেয়া থেকে সরে আসতে হবে।
যেহেতু এভাবে আবাসিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল সে-কারণে সরকারি পর্যায়ে পরিকল্পিত আবাসিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। লক্ষ লক্ষ মাদকাসক্তকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলে আমরা পেতে পারি একটা দক্ষ জনশক্তি।
সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন, ১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।