মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত যে কয়টি শব্দ বা বিষয় সাধারণের মাঝে বিশেষ কৌতুহলের উদ্রেক করে হ্যালুসিনেশন তাদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন কারণে হ্যালুসিনেশন শব্দটি জনপ্রিয়। শব্দটি উচ্চারণে যেমন একটা মজা আছে তেমনি কৌতুহল তৈরি করার মতো এর নানাবিধ উপস্থাপনাও দেখা যায়। কেউ বিষয়টিকে দেখেন একটা মজার বিষয় হিসেবে, কেউ রহস্যময়, কেউ এটাকে নাটক বা উপন্যাসের বিশেষ উপকরণ হিসেবে দেখেন, কেউ আবার বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্তির সাথে হ্যালুসিনেশনকে তুলনাও করে থাকেন। বাস্তবতা হলো হ্যালুসিনেশন একটি অনুভূতি; মোটা দাগে বলতে গেলে বলা উচিৎ এটি একটি অস্বাভাবিক অনুভূতি। অনুভূতি হিসেবে সাধারণ ও সত্যের মতো হলেও এর কার্যকারণ এবং উপস্থিতি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক ও অসংগতিপূর্ণ। এবং যা মোটেও সুখকর নয়।
হ্যালুসিনেশন বিষয়টি কি?
শরীরের বিভিন্ন ঈন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে যে অনুভূতি অনুভব করে থাকি (যেমন; স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ, কিংবা দেখা ও শুনা) হ্যালুসিনেশন এর অনুভূতি ঠিক তেমনই। অবিকল সত্য অনুভব। কিন্তু সেখানে বাস্তব-সত্য কোনো স্টিমুলেশন বা সত্য কোনো বস্তু বা বিষয়ের অবস্থান থাকেনা। এটিই হ্যালুসিনেশনের বিশেষত্ব। অর্থাৎ সত্যি কিছু না থাকা সত্ত্বেও দেখতে পাওয়া বা শুনতে পাওয়া বা স্পর্শ অনুভব করতে পারা বা গন্ধ পাওয়া কিংবা স্বাদ পাওয়া। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, যার অস্তিত্ব নেই সেটিকে অনুভব করা। অস্তিত্বহীন বিষয়ের সত্যি অস্তিত্ব অনুভব করাই হ্যালুসিনেশন।
অনেকেই হ্যালুসিনেশনকে কল্পনা বা চিন্তার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কল্পনা বা চিন্তা করে আমরা যেমন কোনো একটি অস্তিত্বহীন বস্তু বা ঘটনা বা বিষয়কে অনুভব করতে পারি তেমনি আবার চিন্তা না করতে চাইলে সেই অনুভব থেকে সরে আসতে পারি। হ্যালুসিনেশনে সেটা সম্ভব নয়। হ্যালুসিনেশন কোনো কল্পনা নয়! ইচ্ছা করলেই কেউ একজন সেই অনুভূতিগুলিকে নিজের মত করে অনুভব করতে পারেন না। এমনকি ইচ্ছে মতো, সেই অনুভবগুলোকে সরিয়ে দিতে বা তা থেকে সরে আসতেও পারেন না। অর্থাৎ এই অনুভব সত্য অনুভব।
অনুভূতিগুলি নিজের মতো করে আসে বা যায়, থাকে বা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ব্যাপারটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিটির কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব বা কর্তৃত্ব থাকেনা। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আক্রান্ত ব্যক্তিটি বিষয়গুলিকে সম্পূর্ণ সত্য বলেই মনে করেন। যেমন; কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো দেখছেন- তার চারদিকে একজন লোক ঘুরাফেরা করছে, তাঁর সাথে কথা বলছে, তাকে স্পর্শ করছে’ যা একেবারেই তিনি বাস্তব হিসাবে ধরে নিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো লোকের অস্তিত্তই যেখানে নেই। অন্যরা অবশ্যই সেই ব্যক্তিটিকে দেখবেন না বা লোকটির কথা শুনবেন না। কারণ বাস্তবে ঘুরাফেরা করা সেই ব্যক্তিটির অস্তিত্বই আসলে নেই। এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এসেও যদি বোঝানোর চেষ্টা করেন, কাজ হবেনা। তিনি কারো কথা বিশ্বাস করবেনা, বরং তিনি নিজে যা দেখছেন বা শুনছেন সেটাকেই সত্যি বলে মনে করবেন। বোঝানোর ফল হিসেবে উল্টো রেগে যেতে পারেন।
এমনও হতে পারে যে, আক্রান্ত ব্যক্তিটি এক-দুই কিংবা বহু মানুষের কথা শুনতে পান। হতে পারে তিনি, এখানে বসে, আমেরিকায় কেউ কথা বলছে, সেটিও শুনতে পান। কিন্তু বাস্তবতা যতই বোঝানো হোক তাতে লাভ হবেনা। কারণ এখানে যুক্তির বিষয় নয়, বরং বিষয় রোগ ও চিকিৎসার। কেউ কেউ এসবকে অলৌকিক ক্ষমতা হিসাবেও দেখে থাকেন।
অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখে থাকি, রোগাক্রান্ত হবার একেবারে শুরুর দিকে, কিংবা চিকিৎসা চালানোর কিছুদিন পর, যখন রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে, তখন; বিশেষ করে যারা বুদ্ধিমান তাদের অনেকেই ব্যাপারটি বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন অনুভূতিগুলি সত্যি নয়। তখন সেটি তাঁর জন্য হয় সত্যিই কষ্টকর এক অনুভূতির উদাহরণ। অনেকে দুহাতে কান চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন আর বলতে থাকেন; এসব আমি শুনতে চাইনা। অনেকে দেয়ালে মাথা ঠুকরায় পর্যন্ত। এমন অনুভূতি মোটেও কোনো সুখকর ব্যাপার নয়, হতে পারেনা। কানে আসা এসব কথা বা অস্তীত্বহীন এসব অনুভূতি অবশ্যই ঐশ্বরিক কোনো পাওয়ারও নয়। বরং রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিদঘুটে এক অনুভূতি।
কেন হয়?
কেন হয় সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কোন কোন অবস্থায় হ্যালুসিনেশন থাকে বা থাকতে পারে সেসব নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা আছে। প্রধাণত এটি মানসিক সমস্যা বা রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার সাথেও হ্যালুসিনেশন থাকতে পারে। হ্যালুসিনেশন নিজে কোনো রোগ নয়। বরং অন্যকোনো রোগের সাথে উপসর্গ বা সিম্পটম হিসেবে থাকে। তাই শুধু হ্যালুসিনেশন দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় বা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মানসিক রোগের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া, সিভিয়ার মুড ডিসঅর্ডার, ডিলুশনাল ডিসঅর্ডার এর সাথে প্রায়ই হ্যালুসিনেশন থাকে। যারা নেশা করে তাদের মাঝেও বিভিন্ন রকমের হ্যালুসিনেশন দেখা যায়। শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে ব্রেন এর বিভিন্ন সমস্যায় হ্যালুসিনেশন থাকতে পারে। কখনো কখনো এমনকি, শরীরে বিভিন্ন রকমের লবণের তারতম্যের জন্যও সল্পমেয়াদী আকারে হ্যালুসিনেশন থাকতে পারে।
হ্যালুসিনেশন নির্ণয় ও চিকিৎসা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশন বোঝা সহজতর হলেও কখনো কখনো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় হ্যালুসিনেশনকে চিন্তা ইমেজ বা কল্পনার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। যেহেতু হ্যালুসিনেশন নিজে একা থাকেনা, তাই এর পিছনের রোগটির ধরন ধারণের সাথেও এর অনেক মিল থাকে। হ্যালুসিনেশন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সার্বিক রোগ নির্ণয়টিও তাই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই তা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমেই করা উচিৎ। চিকিৎসার বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করে পেছনে থাকা রোগটির উপর। আক্রান্ত রোগটির চিকিৎসাই মূলতঃ হ্যালুসিনেশন এর চিকিৎসা। তবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এর চিকিৎসা এন্টিসাইকোটিক ওষুধ নির্ভর। শারীরিক সমস্যা বা নেশার ক্ষেত্রেও একই কথা, এন্টিসাইকোটিক ওষুধ ব্যবহার করা এবং শারীরিক রোগটির চিকিৎসা বা নেশা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা।
সতর্কতা
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হ্যালুসিনেশনকে যেহেতু আক্রান্ত মানুষটি সত্যি অনুভব বা সত্যি বলে মনে করে তাই সেই অনুভবের উপর মানুষটির নির্ভরতাও থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, হ্যালুসিনেশনের জন্য শুনতে পায়, তুই মরে যা। তুই লাফ দে, তা না হলে তোর ক্ষতি হবে। বিশেষ বিশেষ অসুবিধার কথাও কানে আসতে থাকে, মানুষটি তখন সেটা বিশ্বাস করে এবং সেই মতো কাজ করতে যায় বা করেও ফেলে।
এমন হতে পারে যে, কাছের কোনো একজন মানুষের নাম ধরে বলতে পারে ও তোকে মেরে ফেলবে সুতুরাং তুই ওকে শেষ করে দে। যার সবকিছুকেই মানুষটি সত্যি মনে করে। যার জন্য অনেক বিপদও ঘটে থাকে। সুতরাং এসব বিষয়গুলিকে দ্রুত বুঝে সনাক্ত করা খুবই জরুরি। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসার আওতায় আনা যায় তাতই মঙ্গল।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।