হুমায়ুন ফরীদি

হুমায়ুন ফরিদী
হুমায়ুন ফরিদী
মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে নিজের নাম, এমন কেউ কি আপনার পরিচিত আছেন? এমন কাউকে কি আপনি চেনেন? হ্যাঁ আপনিও চেনেন, তাঁর নাম হুমায়ুন ফরীদি।

মায়ের নাম বেগম ফরিদা, হুমায়ুনের সাথে ফরিদা যোগ করে নাম হয়েছে হুমায়ুন ফরীদি। যাঁর আসল নাম হলো হুমায়ুন কামরুল ইসলাম-এমন অসংখ্য ব্যতিক্রমী ঘটনা, বর্ণনা, ব্যাখ্যা বা সম্বোধনে যাঁকে হাজির করা যায়।

একজন অভিনেতা, একজন বোহেমিয়ান, একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান মানুষ, একজন বাউন্ডুলে, একজন পরোপকারী, একজন বদমেজাজী একরোখা পুরুষ, একজন সহজ সরল মিশুক মানুষ, একজন উদাসীন মানব, একজন বেহিসেবি পেশাজীবী, একজন মুক্তিযোদ্ধা। আরো কী কী নামে তাঁকে উপস্থাপন করা যায়, তাঁর কাছের মানুষরা আরো হয়ত ভালো জানেন।

অনেক রাত, গাড়ি করে বাড়ি ফিরছেন তিনি। বিজয় সরণি মোড়-একজন বৃদ্ধ শীতে কাঁপছে, পরণে লুঙ্গি ছাড়া কিছু নাই। হুমায়ুন ফরীদি নিজের কোট আর শার্ট খুলে ঐ বৃদ্ধকে পরিয়ে দিয়ে চলে এলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, গেলেন মুক্তিযুদ্ধ করতে, ফিরে এসে লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন, শুধুই ঘোরাঘুরি পাঁচ বছর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার অর্থনীতিতে ভর্তি হলেন পাঁচ বছর পর।

খুব সাধারণ মানুষের জীবন কাহিনির সাথে এসব যায় কি? হুমায়ুন ফরীদি নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রকম্পিত অট্টহাসির শব্দ। যে শব্দ একজন দর্শককে আলোড়িত করবে, পর্দার সামনে আটকে রাখবে, ভাবাবে। ভাবনার অন্তরালে ভাসতে ভাসতে একজন দর্শক কখন যে ফরীদির অভিনয়ক্ষমতার গুণে হারিয়ে যাবে সে নিজেও বলতে পারবে না। অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেন ছিলেন ফরীদির কাছের বন্ধু। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘ফরীদির মতো সহজ, সরল, স্বাভাবিক মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। তার মতো বেয়াড়া হওয়ার সাধ্য আমার ছিল না। সে অদ্ভুত বেয়াড়াপনায় সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। পছন্দের, অপছন্দের-সকল মানুষের সাথে ফরীদির আচরণ ছিল সহজ, স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার মধ্যে কেমন অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে। এই অস্বাভাবিক আচরণ একজন বড়ো অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব।’

বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে। চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে যেত তাঁর

অভিনয় গুণে! সংশপ্তক নাটকে তাঁর ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রের অভিনয় যারা দেখেছেন তারা তাঁকে স্থান দিযয়েছেন হৃদয়ের একেবারে মণিকোঠায়। নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন বাণিজ্যিক ধারার বাংলা ছবিতে। হুলিয়া দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। অভিনয়ে এতটাই অনবদ্য ছিলেন যে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে একসময় নায়কের চেয়ে ভিলেন হিসেবে তাঁর চরিত্রটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হলে সেললুয়েডের বিশাল পর্দায় তাঁর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তিত হতে থাকে তাঁর হাত ধরে।

হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে, ঢাকার নারিন্দায়। গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জে। সেখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। বাবার চাকরির সুবাদে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। মাদারীপুরের ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৭০ সালে তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ফরীদিকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই ছিল তাঁর অভিনয়ের পীঠস্থান, প্রখ্যাত সাংস্কৃিতক ব্যক্তিত্ব সেলিম-আল-দ্বীনের সংস্পর্শে এই ক্যাম্পাসে তাঁর দিনগুলোই ছিল জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার দিন। নিখোজঁ সংবাদ নাটকের মাধ্যমে অসাধারণ এই অভিনেতার পর্দায় অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়। বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর পাশাপাশি তার ঝুলিতে আছে হুলিয়া, ব্যাচেলর, মাতৃভা, বহুব্রীহি, আহা, জয়যাত্রা, শ্যামলছায়া’র মতো অনন্য সব চলচ্চিত্র। মাতৃত্ব অভিনয়ের জন্য ২০০৪ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পরুস্কার পান। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে তিনি অতিথি শিক্ষক হিসেবেও বেশ কয়েক বছর ছিলেন তিনি।

বিনোদনের জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন? তাঁর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর স্নেহধন্য ও ভাতৃতুল্য মো. জসীমউদ্দীন বলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদি কেবল অত্যন্ত সরল মনের সদাহাস্য ও মিষ্টভাষী মানুষ ছিলেন না, একইসাথে তিনি ছিলেন তাঁর বিভাগের তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র। সেইসাথে ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন বামধারার রাজনীতির একজন জোরালো সমর্থক’।

হুমায়ুন ফরীদি যা কিছু করেছেন, যেভাবেই করেছেন-সর্বক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষর রেখেছেন। ওয়ান অ্যান্ড ওনলি হুমায়ুন ফরিদী শো। এ দেশের অভিনয় জগতে তাঁকে শ্রেষ্ঠতম চরিত্রাভিনেতা কিংবা মেথড অ্যাক্টর-যেটাই হোক না কেন, একবাক্যে মেনে নেবেন সবাই। বিচিত্র, বেখেয়ালি, বেসামাল আর বেপরোয়া ব্যক্তিজীবনের মতোই বিস্তৃত তাঁর অভিনয়জীবন। নায়ক, খলনায়ক, মহানায়ক-সব সময়ই চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন আবার চরিত্রেই বিলীন হয়েছেন, এ কারণেই তিনি হুমায়ুন ফরিদী।

এটা হয়ত একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। মানুষ ফরীদি রাখঢাক করে কথা বলতেন না, সোজাসাপ্টা আর চাঁছাছোলা শব্দ তাঁর প্রতিনিয়ত ভাষ্য। আর এর সঙ্গে অসামান্য সেন্স অব হিউমার! তাঁর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে লেখায় উঠে আসা এ শব্দগুলো দেখলেও নির্ঘাৎ মশকরা করতেন, আর ভবুন কাঁপানো হাসিতে আন্দোলিত করে তুলতেন চারপাশ! পাগলাটে এই অভিনেতার জীবনকে বিশ্লেষণ করতে গেলে তাঁর চরিত্রের বিশেষ কিছু দিক আলাদা করে চোখে পড়তে বাধ্য।

নাটকে অভিনয় করা এই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনটাও ছিল নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। নিজেকে তিনি নাটকীয় রাখতে বা থাকতে পছন্দ করতেন। কারণ হিস্ট্রিঅনিক পার্সোনালিটির অধিকারী হুমায়ুন ফরীদির চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই যে তেমন ছিল-যারা থাকেন মধ্যমণি হয়ে, যারা প্রতি মুহূর্তে-ঘটনায় নাটকীয়তা পছন্দ করেন। তারা হাসেন, হাসান। এমন মানষুগুলো হন রোমান্টিক, প্রচন্ড কর্মঠ, সামাজিক বা পেশাগত দক্ষতাও যাদের থাকে ঈর্ষণীয়।, তারা তাদের নিজেদের অবস্থার বিষয়ে সঠিক মল্যূায়ন করতেও ব্যর্থ হন, ব্যক্তিগত জীবনের নাটকীয়তার জন্য ঢাকা পড়ে অনেক বাস্তবতা-দুঃখ আর্তনাদ। প্রতিনিয়ত নতুনত্বই তাদের জীবনের পরমংশ। বিষণ্ণতা তাদেরকে জাপটে ধরতে পারে সহজেই।

কী মিল ছিল না এই মানষুটির জীবনে?
প্রথম স্ত্রীর নাম নাজমনু আরা বেগম মিনু। ১৯৮০ সালে তাঁরা দইুজন গাঁটছড়া বাঁধলেও চার বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে তাদের ঘর ভেঙে যায়। শারারাত ইসলাম দেবযানী নামে এই দম্পতির একজন কন্যাসন্তান আছে। এরপর তিনি তাঁর সহকর্মী এবং বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতের আরেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র সুবর্ণা মোস্তফার সঙ্গে সেই একই বছর ঘর বাঁধলেও ২০০৮ সালে অনেক তিক্ততার মধ্য দিয়ে তাঁদের সে ঘর ভেঙে যায়।

ব্যক্তিগত জীবনে সুবর্ণার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকেই অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে থাকেন তিনি। নিজের ওপরে হয়ত প্রতিশোধ নিতে থাকেন। অভিমান করেই। ঘরের মধ্যে তৈরি করেন আরেক ভুবন। সে ভুবনের বাসিন্দা শুধু তিনিই। নিঃসঙ্গতা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে তাঁকে এই এত দিনে। হয়ত বিষণ্ণতার সাথেই তাঁর তখনকার বসবাস। সবসময় বলতেন, ‘বাঁচো আর বাঁচতে দাও।’ বলতেন ‘জীবনটা অনেক দামি, এটার যত্ন করো। পৃথিবী নামক গ্রহে তোমার কোনো অবদান থাকবে না, এটা কীভাবে হয়? হ্যাঁ, এই গ্রহে অনেক সমস্যা, কিন্তু সেটাই সব না। এই গ্রহে সবাই বশু না, এই গ্রহে রবীন্দ্রনাথও আছেন’।

সবসময়ে জীবন সম্পর্কে পজিটিভ কথা বলা, বেঁচে থাকার উৎসাহ দেয়া মানুষটা যে নিজেই একসময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, কেউ তার খোঁজ নেয়নি। হুমায়ুন ফরিদীর জীবনটা যেন অনেকটা দেবদাসের মতো। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাথরুমে পড়ে গিয়ে কী করুণ মৃত্যু হলো তাঁর!

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা বা অন্য যেকোন ধরনের দায়  সর্ম্পূণই লেখকের।

Previous articleবাড়িতে বসে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় মনে রাখবেন যেসব বিষয়
Next articleসাইলেন্ট হাইপোক্সিয়া: কভিড-১৯ রোগের একটি জটিলতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here