সাইকোথেরাপি কী, কখন প্রয়োজন?

0
34
সাইকোথেরাপি কী, কখন প্রয়োজন?

অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন্নাহার
এমবিবিএস, এফসিপিএস (সাইকিয়াট্রি), আইএফএপিএ (ইউএসএ)
সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল,ঢাকা।

সতেরো বছরের রুবানা (আসল নাম নয়)। বাবা-মা নিয়ে এলেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। মেয়েটার হাতে অনেক কাটাছেঁড়ার দাগ। ছয় দিন আগে বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে তাৎক্ষণিক gastric lavage দেওয়া হয় এবং একটু সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শের জন্য বলা হয়।

রোগের ইতিহাস নিয়ে জানা গেল রুবানা প্রায়ই নিজেকে আঘাত (self harm behavior) করে। সে অল্পেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, একাকিত্বে ভোগে, মনে করে কেউ তাকে বোঝে না, বিষণ্ণ বোধ করে। রেগে গেলে রুবানা কিছুতেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

চিৎকার-চেঁচামেচি-জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে। আরো জানা গেল, পাঁচ-ছয় বছর বয়সে সে পরিবারের একজন সদস্য দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। রুবানা ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে case formulation করা হলো।

ডায়াগনোসিস করা হলো Borderlile Personality Disorder (এক ধরনের ব্যক্তিত্বের অসঙ্গতি)। আমরা বললাম চিকিৎসা দু’ভাবে করতে হবে। কিছু ওষুধ লাগবে আর সেই সঙ্গে লাগবে সাইকোথেরাপি। রুবানার ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের সাইকোথেরাপি ডায়ালেক্টিক বিহেভিয়ার থেরাপি (Dialectic Behavior Therapy-DBT)।

পরের সপ্তাহে চেম্বারে আরেকজন রোগী এসে হাজির। আরেফিন (আসল নাম নয়)। বয়স একুশ। নামকরা এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। তার উপসর্গ হলো- সবাই তার ক্ষতি করছে, খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে, মাইক্রোচিপস-এর সাহায্যে শিক্ষকরা তাকে ট্র্যাক করছে, ঘরে ক্যামেরা ফিট করে সর্বক্ষণ তাকে পাহারা দেওয়া হচ্ছে। এসব উপসর্গের সঙ্গে আছে অস্বাভাবিক আচরণ।

বাড়ির খাবার খায় না- নিজে রান্না করে অথবা কলা-বিস্কুট খেয়ে দিন পার করে। ঘুম নেই, সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত, কখনো কখনো হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যায়, মারতে আসে। গত সাত-আট মাস ধরে তার মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে। আমাদের ডায়াগনোসিস হলো সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)। ওষুধ দিলাম। Antipsychotic medications।

তিন সপ্তাহ পর ফলোআপে আসতে বললাম। অভিভাবকরা ওষুধ খাওয়াতে চান না- বলেন, ওষুধের তো অনেক
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কাউন্সিলিং করে ওর লক্ষণগুলো কমানো যায় না? ডক্টর আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না!

ওর ভাবনাগুলো তো ঠিক নয়, আপনি কাউন্সিলিং করলেই ঠিক হয়ে যাবে, আপনার কথা ও ঠিক শুনবে।
বর্তমানে আরেফিনের যে অবস্থা তাতে সে কাউন্সিলিংয়ের জন্য উপযুক্ত নয়।

সে তো বাস্তবতার সঙ্গেই নেই। আমি বোঝালেও সে তো বুঝবে না। আর কাউন্সিলিং সেশনে পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে পঞ্চাশ মিনিট বসে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্যও তার নেই। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, অনেক সময়ে রোগের কারণে যে ক্ষতি হয় তা ওষুধ সেবনের চেয়ে অনেক বেশি।

উল্লেখ্য, সব মানসিক রোগীর জন্য সবসময় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন (indication) নেই। যেসব রোগী সাইকোসিসের active উপসর্গ নিয়ে আসে, সে সময় আমরা সাইকোথেরাপি করার কথা বলি না। রোগীর আছে অলীক প্রত্যক্ষণ (hallucination), ভ্রান্ত ধারণা (delusion), হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, violent আচরণ করা ইত্যাদি।

পরবর্তীতে রোগের উপসর্গ কমে এলে (full/partial remission) প্রয়োজন হলে তাকে সাইকোথেরাপি/কাউন্সিলিং দেওয়া হয়। তবে সাইকোটিক রোগীর ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত সাপোর্টিভ (supportive) সাইকোথেরাপি দিয়ে থাকি।

ক্লায়েন্টের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সামাল দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়, coping mechanism বাড়াতে সাহায্য করা হয় ইত্যাদি। দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম কীভাবে সম্পন্ন করবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এসব নিয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়। এসব রোগীর সাইকোথেরাপির সময় সাধারণত মনের খুব গভীরে গিয়ে কাজ করা হয় না।

সাইকোথেরাপি কী বা কাউন্সিলিং কী? এ দুটো শব্দকে প্রায়ই synonym হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাইকোথেরাপি চিকিৎসায় ডাক্তার-রোগী/ক্লায়েন্ট- থেরাপিস্ট সম্পর্ককে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়। থেরাপিস্টের কর্মদক্ষতা (competence), যোগাযোগের দক্ষতা (communication skill) খুবই জরুরি। বিশেষজ্ঞ সাইকোথেরাপির মাধ্যমে নানারকম কনফ্লিক্ট দূর করে ক্লায়েন্টকে সুস্থ করার চেষ্টা করেন।

সাইকোথেরাপির মাধ্যমে ক্লায়েন্ট তার সমস্যা সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজেই তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করে নেন। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিং করার সময় কিছু এথিকস মেনে চলতে হয়। কোনো অবস্থাতেই রোগীর/ক্লায়েন্টের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।

সর্বদা তার যেভাবে ভালো হয় (for best interest of the patients/clients) সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ক্লায়েন্টের মতামতকেও (autonomy of the client) প্রাধান্য দিতে হবে। অযথা প্রভাব (undue influence) বিস্তার করা একেবারেই ঠিক নয়।

ক্লায়েন্টের সব তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা (to main- tain confidentiality) করতে হবে। এ ব্যাপারে তাকে প্রতিটি সেশনে নিশ্চিত করতে হবে। গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি ক্লায়েন্টের বিশেষ সুবিধা বা অধিকার (privilege of patient) এবং ডাক্তারের দায়িত্ব (responsibility)।

তাছাড়া রোগীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে তার প্রতি সহমর্মী হতে হবে। একটা বিষয় সবসময় মনে রাখতে হবে, ডাক্তার- রোগী/ক্লায়েন্ট-থেরাপিস্ট সম্পর্ক হতে হবে profes- sional অর্থাৎ পেশাদার।

ক্লায়েন্ট-থেরাপিস্ট দীর্ঘ সময় সেশনে নানারকম interaction করে থাকেন। স্বভাবিকভাবেই একে অপরের প্রতি কিছু অনুভূতি (transference and countertransference) তৈরি হয়। এই অনুভূতিগুলো ভালোলাগা খারাপলাগা দু’রকমই হতে পারে। এই অনুভূতির প্রকাশ কিন্তু সর্বদা পেশাদার আচরণ মেনেই হতে হবে।

ক্লায়েন্ট ও থেরাপিস্টের মধ্যে রোম্যান্টিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক একেবারেই unchical। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিংয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোগের বিভিন্ন কারণ ও সেই সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করা (interpreta- tion)।

এই ব্যাখ্যা বা interpretation সাইকোথেরাপি সেশনে সঠিক সময়ে সঠিক পরিস্থিতিতে দিতে হবে। ক্লায়েন্ট যখন সেটা গ্রহণ করতে পারবে, তখনই যেন সেটা দেওয়া হয়। আগেভাগে প্রিম্যাচিউরলি দেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। তাতে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের আরো বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। সেই সঙ্গে সেশনের প্রতি রেজিস্ট্যান্সও হতে পারে।

একটু উদাহরণ দিয়ে বলা যাক, রিনি (আসল নাম নয়) এ লেভেলে পড়ছে। হঠাৎই তার হাত-পা অবশ হয়ে এলো। হিস্ট্রি নিয়ে জানা গেল পরীক্ষায় সে খুব খারাপ ফল করেছে। কিন্তু সেটা সে বাসায় জানায়নি। বরং পরিবারের সবাই জানে, সে ভালোভাবেই পাস করেছে। সেই সঙ্গে আছে তার অনেক বন্ধু-বান্ধব।

ফেসবুক, মোবাইলে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার জন্য মা অনেক বকাবকি করেছে। এরপর থেকেই তার নানা উপসর্গ শুরু হয়। থেরাপিস্ট কিন্তু সহজেই রোগের কারণ বুঝতে পারে কিন্তু রোগী হয়তোবা এই ব্যাখ্যা নেওয়ার জন্য এখনই প্রস্তুত নয়। বরং ব্যাখ্যা দিলে রিনি রেগে যেতে পারে, থেরাপিস্টকে অপছন্দ করতে পারে, সেশন বন্ধও করে দিতে পারে। একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট সহজেই বুঝতে পারেন রোগী কখন ব্যাখ্যা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত।

সাধারণত দু’রকমভাবে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করা হয়- ওষুধ ও সাইকোথেরাপি। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধই প্রধান ভূমিকা রাখে আবার অন্য রোগীদের ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপির ভূমিকা বেশি। এবারে জেনে নেওয়া যাক সাইকোথেরাপির প্রয়োজনীয়তা কী? কাকেইবা আমরা সাইকোথেরাপি করতে বলব?

ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, মাদকাসক্তি, পরিবারের নানা জটিলতা, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব, পরীক্ষা ভীতি, হতাশা, বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ইত্যাদি বিষয়ে সাইকোথেরাপি চিকিৎসা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে এটা মনে রাখতে হবে, রোগী ভেদে বিশেষ বিশেষ ধরনের সাইকোথেরাপি দেওয়া প্রয়োজন। বেশ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে আমরা সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিং দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করি না। যেমন গুরুতর মানসিক রোগী অর্থাৎ সিজোফ্রেনিয়া, একিউট সাইকোসিস, ম্যানিয়া, অরগ্যানিক ব্রেন ডিজিজ (schizophrenia, acute psychosis, mania, organic brain disease)।

আহারজনিত সমস্যা যেমন anorexia nervosa, তীব্র বিষণ্ণতা (severe depression), ব্যক্তিত্বের অসঙ্গতি (severe person- ality disorder) ইত্যাদি। কারো মধ্যে যদি আত্মহত্যার প্রবণতা বা পরিকল্পনা থাকে, তাকেও কিন্তু সেই মুহূর্তে শুধু কাউন্সিলিং দিয়ে কাজ হবে না।

এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে এবং সেই সঙ্গে দরকার সমন্বিত চিকিৎসা সেবা। মাদকাসক্ত রোগীদের আমরা কাউন্সিলিং সেবা দিয়ে থাকি কিন্তু মনে রাখতে হবে, রোগীকে প্রথমেই মাদকমুক্ত (med- ical detoxification) করতে হব।

অতিরিক্ত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করার সময় রোগী সাইকোথেরাপি সেশনে একেবারেই মনোযোগী হতে পারে না। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিং মানসিক রোগীদের জন্য একটা কার্যকর চিকিৎসা সেবা। অনেকেই মনে করেন সাইকোথেরাপির কোনো খারাপ দিক নেই।

সত্য হলো, সাইকোথেরাপিরও কিছু নেতিবাচক দিক আছে। থেরাপিস্টের দক্ষতা, তার ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার- রোগী/ক্লায়েন্ট-থেরাপিস্ট সম্পর্ক, প্রিম্যাচিউর inter-pretation, ত্রুটিযুক্ত থেরাপি কৌশল ইত্যাদি ফ্যাক্টর রোগী/ক্লায়েন্টের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সাইকোথেরাপি সেশনে অন্তর্ভুক্তির জন্য ক্লায়েন্টের ইতিবাচক মানসিক অন্তর্দৃষ্টি ও প্রেরণা থাকা খুব প্রয়োজন। আরো মনে রাখতে হবে, সেশনে ভায়োলেন্স কখনোই কাম্য নয়।

Previous articleসব সময় মন খারাপ থাকা
Next articleআমি ইন্ট্রোভার্ট- এজন্য কেউ কেউ বলে বলদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here