১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে অনুষ্ঠিত হলো গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল বৈঠক। এই বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (BAP), এবং এর মিডিয়া পার্টনার ছিল মনের খবর টিভি।
বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য সমাধান।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মোত্তালিব। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস এর যুগ্ম আহ্বায়ক মেজর (অব.) প্রফেসর ডা. মো. আব্দুল ওয়াহাব , সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন এবং ডা. মোহাম্মদ জুবায়ের মিয়া, ডা. মো. রাহানুল ইসলাম, ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল এবং অন্যান্য সদস্যারা ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবু সাঈদ,
জাতীয় নাগরিক নির্বাহী কমিটির সংগঠক এডভোকেট আলী নাসির খান, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের সিনিয়র সভাপতি এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব, ইউনিসেফ প্রতিনিধি ডা. সাবরিনা রাফি এবং বস্তিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ট্রান্সফোরম প্রজেক্টের ম্যানেজার ডা. আজমেরী। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার মো. তৈয়বুর রহমান।
অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে শহীদ ও আহতদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা এবং দারগোড়ায় মানসিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
ডা. মো. রাহানুল ইসলাম জানান, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ৯২% মানুষ চিকিৎসা নেয় না। তিনি শহর ও গ্রামে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার আহ্বান জানান।
এডভোকেট আলী নাসির খান বলেন, আন্দোলনের পর মানসিক চাপের কারণে মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি।
অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, BSMMU তে অন্য ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া ৪৮% রোগীরা মানসিক স্বাস্থ্যর সমস্যায় ভোগেন। তিনি বলেন মানসিক স্বাস্থ্য পিছিয়ে আছে, তাকে এগিয়ে নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে সঠিক তথ্যের গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেন।
আরজে নিরব বলেন ,পাড়া-মহল্লায় মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিট চালুর প্রস্তাব দেন এবং স্টিগমা ভাঙতে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেন।
ডা. সাবরিনা রাফি মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে একশন প্ল্যানভিত্তিক ওয়ার্কশপ আয়োজনের প্রস্তাব দেন। তিনি জানান, DGHS এবং DGME-এর সাথে সহযোগিতায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কারিকুলাম উন্নয়নে কাজ করছেন।
ডা. মুনতাসির মারুফ জানান, কড়াইল বস্তিতে আউটডোর মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে এবং NITOR-এ কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
মাওলানা তানজিলুর রহমান তার বক্তব্যর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেন। আল্লাহর বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” তিনি জানান, ওষুধের পাশাপাশি ধর্মীয় কাজে মনোযোগ দিলে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হতে পারে।
গণঅভ্যুত্থানের সমন্বয়ক নাহিদা বুশরা বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শহীদদের পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাত ধীরে ধীরে উন্নতি করছে।
ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের সিনিয়র সভাপতি এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ বলেন, তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অবদানের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, জাতি শত বছর ধরে তা স্মরণ করবে। তিনি প্রশাসন, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন। তিনি চিকিৎসকদের নৈতিকতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন এবং বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসকে পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস দেন।
ডা. আব্দুল ওয়াহাব মিনার জাতি গঠনে যোগ্যতার গুরুত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। নবীন প্রজন্ম যেন শৈরাচারে পরিণত না হয়। তাদের চিন্তার গভীরতা ও মানসিক সক্ষমতা আমাদের থেকে এগিয়ে গেছে। বন্যার পর জমিতে পলি জমে, সেখানে ফসল ফলাতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন আত্মহত্যার চেষ্টা যে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এই আইন সংশোধন করতে হবে। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সব সেক্টরকে পাশাপাশি একসাথে কাজ করতে হবে।
এই বক্তব্যগুলো গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।
গণঅভ্যুত্থানের সমন্বয়কারী রাতুল ও মাহরিন ”হোপ ওয়েব” নামক একটি কার্যক্রম শুরু করেছেন, যার মাধ্যমে আহত শিক্ষার্থী এবং শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকের শেষ বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মোত্তালিব অংশগ্রহণকারী ও সহায়তাকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত রাখতে হবে। পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বন্ধ করার আহ্বান জানান।
গোলটেবিল বৈঠকটি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এই বৈঠক একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন: