আমরা চিন্তা করি ২৪ ঘন্টার যেকোন একসময় আট (৮) ঘন্টা ঘুমালেই শরীর ভালো থাকবে। তবে আপনিও যদি এটা ভেবে থাকেন তবে হ্যা আপনি ভুল চিন্তা করছেন। মধ্যরাতে ঘুমিয়ে দুপুর বেলা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা ঘুমালেও সময়মতো আট ঘণ্টার ঘুমের উপকার পাওয়া যাবে না।
এই ব্যবস্থার পেছনে দায়ী শরীরের জৈবিক ঘড়ি ‘সার্কাডিয়ান রিদম’, যা মস্তিষ্কের সংকেত পাঠায় ঠিক কখন ঘুমানোর সময়। ‘সার্কাডিয়ান রিদম’য়ের অবাধ্য হলে শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
সাধারণত কখন ঘুমানোর সময় আর কখন জেগে থাকার সময় সেটা মস্তিষ্ককে জানায় ‘সার্কাডিয়ান রিদম’। এমনকি ঘুমের মধ্যেও আশপাশের পরিবেশ অনুযায়ী কখন কি করতে হবে আর কখন গভীর ঘুমে ডুবে যেতে হবে সেটাও ঠিক করে দেয়। পৃথিবীর কক্ষপথ পরিমণ্ডলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে এই ‘সার্কাডিয়ান রিদম’, যা ছাড়া শরীর কতটুকু কর্মশক্তি কখন কাজে লাগাবে তা নির্ধারণ করতে পারতো না।
এই ব্যবস্থা যদিও আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। তবে এটা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে আমরা যে দৈনন্দিন জীবনে সমস্যায় পড়তাম এটা নিশ্চিত।
ঘুম বিশেষজ্ঞ ও ‘নিউরোসাইন্টিটিস্ট’ ড. চেলসি রোশেব বলেন, “চোখের মাধ্যমে যে সূর্যের আলো প্রবেশ করে তা দিয়েই ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ নিয়ন্ত্রিত হয়। চোখে যখন আলো তখন মস্তিস্ক ‘মেলাটোনিন’ হরমোনকে দমিয়ে দেয়। আর এই হরমোনই মানুষের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় কখন ঘুম দরকার। একইভাবে সন্ধ্যার পর চারদিক যখন অন্ধকার হয়ে আসে তখন ‘মেলাটোনিন’ উৎপাদন বেড়ে যায় এবং একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় গিয়ে থেমে যায়। আর তখনই মস্তিষ্কে সংকেত যায় যে ঘুমানো সময় হয়েছে।”
সাধারণত এই মেলাটনিন সংকেত ভালোভাবে আর্বিভূত হয় মধ্যরাতের আগে। তাই মধ্যরাতের পর থেকে যতই জেগে থাকা হবে ততই শরীরের জন্য খারাপ হবে । এবং এটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে আমাদের শরীরে।
“আমরা যখন ‘টাইম জোন’ অতিক্রম করি তখন এই ঘুমের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়।” ব্যাখ্যা করেন ঘুম-গবেষক ড. নেরিনা নামলাখান।
‘দি লিটল বুক অফ স্লিপ: দি আর্ট অফ ন্যাচারাল স্লিপ’ বইয়ের এই লেখক আরও বলেন, “তাপমাত্রা, আলোর ওঠা-নামা এরকম প্রাকৃতিক কারণেও ‘সার্কাডিয়ান’ সময়ের ওপর প্রভাব রাখে। ফলে সময় সম্পর্কে ধারণা পেলে শরীরের সমস্যা হয়।”
রোশেব আরও বলেন, “মাঝরাতের আগেই যদি আপনি ঘুমিয়ে পড়েন তবে দিনের বেলা লম্বা সময় সূর্যের আলো চোখে প্রবেশ করবে। ফলে শরীরের ‘মেলাটোনিন’ হরমোনের ভারসাম্য থাকবে স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। আর এমনটা না হলে, ‘সার্কাডিয়ান রিদম’য়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, যে কারণে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে যাওয়ার পরও ঘুম আসবে না, ঘুম ভেঙে যাবে।”
রাতের দেরি করে ঘুমানো আর ঘুম থেকে উঠতে দুপুর গড়িয়ে ফেলার অভ্যাস যাদের তৈরি হয়ে যায় তাদের জীবনের আয়ু কমতে থাকে বলে দাবি করে গবেষণা। পাশাপাশি তারা মনযোগ রাখতে পারে না, জ্ঞান আহরণের ক্ষমতা কমে, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে থাকে।
“মাঝরাতের আগের ঘুমটা শরীর ও মস্তিষ্কের ক্ষয় পূরণের জন্য সবচাইতে জরুরি। আর তা করতে পারলে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীর ও মন দুটোই থাকে তরতাজা। দিনে তাড়াতাড়ি উঠলে কাজগুলো সেরে ফেলার জন্য সময়টাও কিন্তু বেশি পাওয়া যায়। আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাসগুলো রপ্ত করাও সহজ হয়,” বলেন ড. রামলাখান।
কাজের প্রয়োজনে প্রতিদিন রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব হয় না এটাই বাস্তবতা। এমনটা কালেভদ্রে হলে সমস্যা নেই। তবে নিয়মিত হলেই সমস্যা।
রোশেব বলেন, “দেরিতে ঘুমালে, যত বেশিই ঘুম হোক না কেনো ক্লান্তি দূর হয় না। অবসাদ আর ‘থাইরয়েড’ হরমোনের সমস্যা দেখা দিতে পারে সেকারণে। আবার দেরিতে ঘুমানোর কারণে অভ্যাসের বেশি ঘুমিয়ে ফেলেন অনেকেই। ফলে ঘুম থেকে ওঠার পরও শরীর ম্যাজম্যাজ করে, আধোঘুম লেগে চোখে মুখে। এসময় মেজাজ খিটখিটে থাকে, কোনো কাজেই মনযোগ দেওয়া যায় না, আবার ঘুমাতে ইচ্ছা করে।”
এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে একসময় মেজাজের ওপর স্থায়ী প্রভাব পড়বে, সঙ্গে ঘটবে শারীরিক স্বাস্থ্যহানিও।
তাই চেষ্টা করতে হবে রাত ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে। শহুরে জীবনে এটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হতে পারে। তবে ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ এই বাজে অভ্যাস গড়ে তুলেছে যা তাদের জন্য নয় শুধু পুরো জাতির জন্যই ক্ষতির। আমাদের সবারই উচিত সঠিক সময়ে ঘুমানো।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে