ডা. নাসিম জাহান
সহযোগী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
বর্তমান সমাজের উন্নতির পথে দ্রæত ধাবনের ফলে কর্মজীবী মানুষের সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকা যেন হয়ে পড়েছে অতি স্বাভাবিক নিয়ম, হোক সেটা শারীরিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক। আমরা সারাক্ষণই যেন দৌড়ে বেড়াচ্ছি কোনো এক অজানা টানে। এই যে সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকা এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আছে ব্যক্তির স্বাস্থ্যের মনোসামাজিক অংশে। কিন্তু কিছু সুস্থ বিনোদন এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হয়ে ব্যক্তির কর্ম ও ব্যক্তি জীবনের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। আসুন জেনে নেই কিছু সাধারণ ঘটনা যা অহরহ ঘটে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমরা হয় খেয়াল করছি না বা করতে চাচ্ছি না।
কেস ১: সুমন তার ইমোশন ধরে রাখতে না পেরে কেঁদেই ফেললেন তার সাইকোলজিস্টের সামনে। বলে চললেন, ‘‘কি না করেছি ওর জন্য আমি! সারাদিন খেটে গেছি অমানবিক, বাসায় ফিরেছি এত রাতে! আবার সকালে ঘুম পুরা না হতেই দৌড়াতে হয়েছিল! ছুটির দিনেও বাড়তি কাজ করেছি, শুধুমাত্র সংসারের জন্য! আর মিনা এই কথা বলছে আজ?’’ চুপ করে থাকলো না মিনাও, ‘‘তোমার কাছে আমার কি চাওয়ার ছিল সেটা কি জানতে চেয়েছিলে কোনোদিন? আমি তো অত টাকা চাইনি! আমাকে কি তোমার কিছুটা সময় দেয়ার ছিল না একেবারেই? খুব দামি শাড়ির চেয়ে আমার ভালো লাগত যদি তুমি হাতে নিয়ে আসতে একটা ফুল! বিভিন্নভাবে আমি বোঝানোর চেষ্টাও করেছি সেটা, তুমি বুঝতে চেয়েছে কখনো?’’
তাদের ১০ বছরের সাজানো সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনই তাদের সাইকোলজিস্টের কাছে আসার কারণ!
কেস ২: মেয়েটা দিন দিন কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, সারাক্ষণ যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকছে। কারও সাথে মিশতেই চাচ্ছে না, অথচ স্বাভাবিক হাসিখুশি থাকতো আগে! বাড়ন্ত বয়স তার, মাত্র ষোলতে পা দিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাবা তাকে বাইরে যেতে দিতে চায় না। নিজেও নিয়ে যাবার সময় পায় না একদমই। তার কথা হচ্ছে ঘরে বসে পড়াশোনা করবে টিভি দেখবে আর কিছুর দরকার কি? মেয়েটার ইচ্ছা ছিল গান শেখার, বন্ধুদের সাথে বা পরিবারের সাথে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়ার। তার বাবার সবেতেই আপত্তি। নিজের প্রতি স্বামীর এই ধরনের আচরণ আর অবহেলা মেনে নিয়েছিলেন মিসেস জহির। কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ের প্রতিও এমন আচরণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়েই পরিচিত এক সাইকোলজিস্টের কাছে আসা।
প্রথম কেসে আমরা দেখতে পাচ্ছি মিনা নামের মেয়েটির চাহিদা ছিল তার হাজবেন্ডের কাছে কিছুটা সময়, অবশ্যই সেটা হতে হতো ‘কোয়ালিটি টাইম’। মনের চাহিদাটা আমরা প্রায় সময়ই বুঝার চেষ্টা করি না। অনেক সময় দামি কিছু নয় খুব সাধারণ কিছু জিনিস প্রিয় মানুষের কাছে আমরা আশা করি। অনেকের ধারণা বিনোদন মানেই হচ্ছে খুব দামি কিছু কিন্তু সেটা মোটেই ঠিক নয়। সুস্থ বিনোদন আমরা তখনই বলবো যেটা আমাদের সাধের মধ্যে এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, আর এটি কখনো নেশাগ্রস্ত করে না। সুস্থ বিনোদনে পরিবারের সবাই মিলে অংশগ্রহণ করতে পারে।
দ্বিতীয় কেসেও আমরা একই সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটির বাবা বিনোদন থেকে বঞ্চিত করছে তাকে। তার বয়স অনুযায়ী কিছু বিনোদন অবশ্যই দেয়া উচিত। সুস্থ বিনোদন ছাড়া আমাদের রিলাক্সেশন হয় না আর রিলাক্সেশন না হলে আমরা সঠিকভাবে কাজে মনোযোগও দিতে পারি না। তাছারা, সুস্থ বিনোদন আমাদের সামাজিক দক্ষতাও বাড়ায়, পারিবারিক বন্ধন দৃৃঢ় করে, মনকে প্রফুল্ল রাখে। এইজন্য সুস্থ বিনোদনের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা আছে।
এমন হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে আমাদের আশেপাশে। যখন আমরা সুস্থ বিনোদন দিতে পারছি না তখন আমাদের প্রিয়জনেরা জড়িয়ে পড়ছে অস্বাস্থ্যকর কিছু অভ্যাসেÑএমনকি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে তারা। বিনোদন আমাদের মনকে করে প্রশান্ত। কোয়ালিটি টাইম অনেক বেশি হতে হবে এমন নয়। সঙ্গীকে যদি আমরা অল্প সময়ও দেই এবং সেটা যদি মানসম্মত হয় তাহলে মনে শান্তি থেকে যায় অনেক সময় ধরে, ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়, দূরত্ব দূর হয়। অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রী বুঝতে পারেন না তার পার্টনারের মধ্যে মানসিক চাহিদাটা রয়ে যাচ্ছে। খুব সামান্য আচরণগত পরিবর্তনেই এই চাহিদা কিন্তু মেটানো সম্ভব। সুমনের উদাহরণটিতে যেখানে দেখা যাচ্ছে মিনা তার কাছে শুধুমাত্র সামান্য কিছু সময় এবং সুস্থ বিনোদন চেয়েছিল।আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হই। আমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদেরকে কোয়ালিটি টাইম দিয়ে দিয়ে ভালো রাখার চেষ্টা করি। সমাজে আজকাল দেখা যাচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছে, ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতি এর পিছনের কারণ। আমরা যেটা করতে পারি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বা বাবা-মায়ের সম্পর্ককে ভালো রাখতে হলে যোগাযোগে বাড়াতে পারি। এই যোগাযোগ সবসময় সরাসরি হতে হবে এমন নয়। সময়ের অভাব থাকলে অনেকভাবেই যোগাযোগ করা যায় আজকাল। দিনে অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসএমএস বা টেক্সট করা, ফোনে কথা বলা, খোঁজখবর রাখা, সপ্তাহে অন্তত ১ দিন কাছাকাছি কোথাও হলেও ঘুরতে যাওয়া, টুকটাক ছোটোখাটো উপহার হাতে নিয়ে বাসায় ফেরা, প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে সাহায্য করা সম্পকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। তাই পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য এবং সংসারে ঝামেলা কমাতে সুস্থ বিনোদনমূলক কাজ উৎসাহিত করা অবশ্যই জরুরি।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
- চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
মগবাজার রেইল গেইট।
নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
(ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০ - আরো পড়ুন- ডিভাইসের অপব্যবহার মানসিক রোগের কারণ?