শিশুকালের প্রথম আট বছর অত্যন্ত জরুরি। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশ সবচেয়ে দ্রুত হয় মাতৃগর্ভে যা প্রায় শতকরা আশি ভাগ। আর অবশিষ্ট বিশ শতাংশ বৃদ্ধি হয় জীবনের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত। এই সময়টা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য বেড়ে ওঠা এবং বিকাশের ভিত্তি। এ সময়ে শিশুরা অন্য যে কোনো সময়ের থেকে তাড়াতাড়ি শেখে। ছোটবেলায় শিশুরা যে যত্ন ও ভালোবাসা পায় তা অত্যন্ত জরুরি এটা তাদের সারা জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। বাচ্চারা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এবং তাড়াতাড়ি শেখে যদি তারা ভালোবাসা, দেখাশোনা, উৎসাহ এবং মানসিক উদ্দীপনা পায় এবং তার সাথে থাকে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা।
জন্মের পর শিশুর বিকাশের গতি বিভিন্ন হয়। কম পুষ্টি, খারাপ স্বাস্থ্য বা উদ্দীপনার অভাবের জন্য শিশুর অগ্রগতি দেরী করে হতে পারে।
পাঁচ থেকে আট বছর বয়সে শিশুর যা পারা উচিত:
– সম্পূর্ন বাক্যে অর্থপূর্ণ কথা বলতে পারে।
– নিজের সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। যেমন-দাঁত মাজা, গোসল করা, খাওয়া, পড়া ইত্যাদি।
– পছন্দমতো যে কোনো কাজ নিজে নিজে করতে পারে। যেমন- গান গাওয়া, ছবি আঁকা, খেলা, বই পড়া ইত্যাদি।
– পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি বুঝে ও চলতে পারে।
– নিজের সম্পর্কে সচেতন থাকে।
– নিজেরভাল-মন্দ বুঝতে শেখে।
– বেশী সময় ধরে যে কোনো কাজ করতে পারে।
– ছোটোখাটো সমস্যা নিজ থেকে সমাধান করতে পারে।
– নিজের পছন্দের খাবারের প্রতি সচেতন হয় এবং নিজ থেকে খাবার খেতে পারে। সহজ পদ্ধতিতে খাবার তৈরি করতে পারে। যেমন- রুটিতে জেলী বা মাখন লাগানো, দুধ তৈরি করা ইত্যাদি।
– যথাযথ আবেগ প্রদর্শন করতে পারে।
– আবেগ সম্পর্কে বুঝে এবং প্রয়োজনীয় আবেগ প্রয়োগ করতে পারে।
– বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখায়।
এ বয়সী শিশুর জন্য যা করণীয়:
– শিশুরা তাদের আপনজনদের অনুকরণ করতে পছন্দ করে। এসময়ে শিশুদের নতুন এবং আকর্ষকণীয় বস্তু দেখতে বা খেলতে দিয়ে ওদের শিখতে সাহায্য করতে হবে।
– মা-বাবা এবং স্বজনেরা বাচ্চার সাথে যত বেশী কথা বলবে, তত তাড়াতাড়ি বাচ্চা শিখবে। শিশুরা সবসময় কথার অর্থ বুঝতে না পারলেও এই প্রাথমিক কথোপকথন শিশুর ভাষা ও লেখার ক্ষমতার বিকাশ করে।
– শিশুদের প্রথমে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা দরকার, এটা শিশুর ভাববার ও প্রকাশ করবার ক্ষমতা বাড়ায়।
– শিশুদের দীর্ঘ সময় একা ছেড়ে দেয়া উচিৎ না। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
– নতুন কিছু করতে বা বলতে শিখলে সব বাচ্চাকেই উৎসাহ দেওয়া ও প্রশংসা করা দরকার।
– শিশুকে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করুন এবং ওর ধারণাসমূহকে অনুসরণ করুন।
– বাবার সাথে খেলা ও কথাবার্তা বলা, বাবা ও শিশুর সম্পর্ক জোরদার করে।
– মা-বাবাকে ধৈর্য্ শীল হওয়া দরকার যখন একটা ছোট শিশু নিজে নিজে কিছু করতে চায়। বিপদ থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় নতুন ও কষ্টকর কিছু করার চেষ্টা শিশুর বিকাশের জন্য ইতিবাচক।
– বাচ্চাদের ক্রমাগত পরিবর্তন হয় এবং নতুন ক্ষমতা অর্জন করে। মা-বাবার উচিৎ ওদের পরিবর্তন লক্ষ্য করা এবং গতিবিধি অনুসরণ করে আরও দ্রুত বিকাশে সাহায্য করা।
– অপেক্ষাকৃত বড়শিশুদের তৈরি উদাহরণ শিশুদের ব্যবহার গঠনে খুব জোরালো প্রভাবশালী হয়। শিশুরা অন্যদের অনুকরণ করে শেখে, ওদেরকে কী করতে বলা হচ্ছে সেটা শুনে নয়। যদি বড়রা চিৎকার করে চরম ব্যবহার করে শিশুরাও ওইরকম ব্যবহার শিখবে। বড়রা যদি অন্যদের সাথে সম্মান এবং ধৈয্যের সাথে ব্যবহার করে, শিশুরাও অনুসরণ করবে।
– শিশুরা ভান করতে ভালোবাসে। এটাতে উৎসাহদান দরকার যেহেতু এটা শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়ায়। অন্যরা কেমন ব্যবহার করে বুঝতে ও গ্রহণ করে নিতে সাহায্য করে।
– তাকে তার মত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আচরণ করতে দিন। যদি মনে করেন শিশুটি ভুল করছে, তবে তাকে আন্তরিকভাবে বোঝান। কখনই কড়া শাসন করবেন না।
– শিশুর প্রতিদিন ১৬০০-২০০০ ক্যালোরী খাদ্য দরকার, তাই শিশুর বিকাশের জন্য সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সমন্নয়ে সুষম খাদ্য খাওয়ান।
– শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বাদাম (যেমন-আখরোট, চিনা বাদাম, কাঠ বাদাম ইত্যাদি) মধু, ডিম, pulses (dal), দুধ, মাছ (sea fish), মাছের তেল, ফল (যেমন-কলা, আপেল, জাম, আমলকি ইত্যাদি) ইত্যাদি খাদ্য অতি প্রয়োজনীয়।
– শিশুর বিকাশের জন্য প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে। প্রতিদিনই খাবারের তালিকায় বৈচিত্র থাকতে হবে যাতে শিশু একই ধরনের খাদ্যে বিরক্ত না হয়।
– প্রতিদিনই খাদ্য তালিকাতে দুধ, ডিম, বাদাম ও ফলমূল ও শাকসব্জি রাখতে হবে।
– পারিবারিক-সামাজিক রীতিনীতি ও ভালো-মন্দ শেখান।
– সময় মতো শিশুকে যথেষ্ট ঘুমাতে দিন।
যে সব সংকেত লক্ষ্য রাখতে হবে:
– পিতা-মাতা ও যত্নকারীদের প্রয়োজনীয় মানদন্ড জানা দরকার, যা জানাবে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে কী না। তাদের এটাও জানা দরকার যে, কখন সাহায্য চাইতে হবে এবং কি করে শারীরিক বা মানসিকভাবে অসমর্থ শিশুর জন্য যত্ন ও ভালোবাসার পরিবেশ তৈরি করা যাবে।
– স্পর্শ, শব্দ এবং দৃশ্যে বাচ্চাদের কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তা লক্ষ্য করে পিতা-মাতারা বুঝতে পারবেন যে, বাচ্চার বিকাশের সমস্যা আছে কী না।
– শিশু মৃত্যুর সংখ্যার অর্ধেকের চেয়েও বেশির কারণ অপুষ্টি, দুর্বলতা ও রোগের সাথে লড়তে না পারার ক্ষমতা। অপর্যাপ্ত খাবার, বার বার অসুস্থ হওয়া সঠিক খেয়াল না রাখার কারণে শিশুরা রোগ এবং অপুষ্টিতে ভুগতে পারে।
– অন্যদের সাথে না খেলে একা একা বসে থাকা বা হঠাৎ করে স্বাভাবিক কাজকর্মে উৎসাহ হারানো।
– কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সবসময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যত্ন নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারো সঙ্গে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার, ঘরের জিনিসপত্র চুরি করা, বাইরে থেকে অন্যের জিনিস চুরি করে নিয়ে আসা, টাকা পয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা, নিজের শরীরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেড়া, হাত কামড়ানো, মাথা পেটানো, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুল পালানো, স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, কানে গায়েবি আওয়াজ শোনা, যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করলে বুঝতে হবে শিশুটি মাসসিক সমস্যায় ভুগছে।
– পিতামাতাকে বোঝাতে হবে শিশুর সাথে কথা বলতে ও শুনতে। তাতেও সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে।
– খেলার সময় বাচ্চা কেমন করে অংশ নেয় খেয়াল করুন। যদি সে ভীত হয়, রাগারাগি করে বা মারামারি করে সেটা আবেগজনিত সমস্যা বা নির্যাতনের চিহ্ন হতে পারে।
– যদি কোনো শিশুর মানসিক বা আবেগজনিত সমস্যা থাকে, নির্যাতিত হয়ে থাকে, তাকে পরামর্শদান করাতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আরও জটিলতা না হয়। প্রযোজনে বিশেষজ্ঞের মতামত নিন যাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্ণয় করতে পারেন শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিনা।
পারিবারিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক কারণে অনেক শিশু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এছাড়া শরীর গঠনের সময় কোনো ধরনের বাধা পড়লে পরিণতিতে শিশু মানসিক রোগগ্রস্থ হতে পারে। সাধারণ ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো শিশুকে রোগী বা অসুস্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রয়োজনে একজন দক্ষ মনোরোগ চিকিৎসকের পরারর্শ নিন।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।