ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ।
হাসাহাসির মাঝখানে হঠাৎ করেই স্মিতার রাগটা চড়ে গেল, বন্ধুদের আড্ডা থেকে উঠেই হনহন করে হাঁটা দিল সে। দু—তিনজন বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। “এটা কোনো কথা! এই মেয়েটা কথায় কথায় রাগ করে, সেন্টি খায়! এর তো মনে হয় বাইপোলার রোগ, তার মানসিক চিকিৎসা দরকার” বলে উঠল আনান।
পাশে বসে ইতি ভাবছিল ভিন্ন কথা। স্মিতার এই মুড সুইং নতুন কিছু না। কয়েকদিন ভালো থাকে, হঠাৎ করেই শুরু হয় তার মনের এই রোদ এই বৃষ্টি অবস্থা। আসলেই কি স্মিতা বাইপোলার রোগে ভুগছে? এই মুড সুইং মানেই কি বাইপোলার?
নাহ! ইতি ঠিক করল আপুকে জিজ্ঞেস করবে। বড়ো আপু সাইকিয়াট্রিস্ট হবার ট্রেইনিং করছে, তার কাছ থেকেই জেনে নিবে ব্যাপারটা। যেই ভাবা সেই কাজ, আপুকে ফোন করতে আপু বলল স্মিতাকে নিয়েই উনার ডিপার্টমেন্টে যেতে, খুব বেশি দূরে নয় আপুর হাসপাতাল। শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে—সুঝিয়ে স্মিতা আর আনানকে নিয়ে আপুর সাথে দেখা করতে গেল। আপু তার একজন ম্যাডামের সাথে বসে আমাদের ডাকলো। মিষ্টি চেহারার ম্যাডাম ভীষণ মিষ্টি হেসে আমাদের স্বাগত জানালেন। তিনি আমাদের মুড সুইং নিয়ে অনেক তথ্য জানালেন।
মুড সুইং কী?
মুড সুইং হলো মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন। তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হুটহাট হয়ে যায় মেজাজের এই পরিবর্তন। এতে আশেপাশের মানুষের মনে যেমন বিরক্তির উদ্রেক হয়, রোগী নিজেও কষ্টে থাকেন নিজের মেজাজের পরিবর্তনে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার কী?
বাইপোলার ডিজঅর্ডার একধরনের মানসিক রোগ। বাইপোলার শব্দের অর্থ ‘দুই প্রান্ত’। বাইপোলার নাম শুনলেই বোঝা যায় এ রোগের প্রধানত দুই ধরনের লক্ষণ রয়েছে, যা সম্পূর্ণ একে অন্যের থেকে বিপরীত। বাইপোল ডিজঅর্ডার দুই ধরনের। একটি হচ্ছে ম্যানিয়া বা ম্যানিক এপিসোড এবং অন্যটি হচ্ছে ডিপ্রেশন বা ডিপ্রেসিভ এপিসোড। ম্যানিক এপিসোডে রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রায় উত্তেজনা কাজ করে এবং আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। অকারণেই অনেক হাসিখুশি বোধ করে, কিংবা অনেক বেশি কথা বলে থাকে। অন্যদিকে, ডিপ্রেসিভ এপিসোডে রোগী খুবই বিষণ্ণতায় ভোগে। হতাশ থাকে,আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় আত্মহত্যার চিন্তাও আসে রোগীর মধ্যে। উল্লেখ্য যে, ‘এপিসোড’ কথাটি বলার কারণ হচ্ছে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের দুই প্রকারের যেকোনো একটি একাটানা নির্দিষ্ট পিরিয়ড পর্যন্ত চলতে পারে।
কখন মুড সুইং বাইপোলারে রূপান্তরিত হতে পারে?
মুড সুইং (গড়ড়ফ ঝরিহম) যেকোনো মানুষেরই হতে পারে। তবে সেটি যদি ঘনঘন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ হয়, এবং সেটা একজনের স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়; তাহলে এই অস্বাভাবিক পর্যায়টিই বাইপোলার ডিজঅর্ডার (ইরঢ়ড়ষধৎ উরংড়ৎফবৎ)। তাই মেজাজে আকস্মিক পরিবর্তন হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি বাইপোলার ডিজঅর্ডারের সাথে বসবাস করছেন।
কেন মুড সুইং হয়?
সামান্য মুড সুইং যে কারো হতে পারে। কিন্তু সবসময় যাদের মুড সুইং হয়, তাদের ক্ষেত্রে কেন হয়? মস্তিষ্কে কয়েকটি নিউরোট্রান্সমিটার থাকে। যা থেকে হরমোন ক্ষরণও হয়। যার মধ্যে সেরোটোনিন ও নরএপিনেফ্রিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আমাদের ঘুমের ধরন, নানা রকমের মানসিক স্থিতি ও আবেগের ওঠানামার সঙ্গে জড়িত। আর দ্বিতীয়টির সম্পর্ক, কোনো কিছু শেখার দক্ষতা, স্মৃতি ও শারীরিক চাহিদার সঙ্গে। এই হরমোনের তারতম্যের কারণে মুড সুইং হতে পারে। সাধারণত মানসিক চাপ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থেকেও হতে পারে। যেমন : মেয়েদের পিরিয়ড পূর্ববর্তী হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা, মেনোপোজের সময় কিংবা গর্ভকালীন সময়ে মুড সুইং হতে পারে। এছাড়া একজন ব্যক্তির ঘুমের ধরন, মাদক বা অ্যালকোহল ব্যবহারও এর কারণ। আর বিভিন্ন মানসিক রোগ, যেমন : বাইপোলার ডিজঅর্ডার, বিষণ্ণতা, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (অউঐউ), মৃগীরোগ এবং অটিজম স্পেকট্রাম ইত্যাদি মানসিক সমস্যার কারণেও মুড সুইং হতে পারে।
কী করণীয়?
প্রথমেই জেনে নিতে হবে মুড সুইং কেন হচ্ছে, তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি এমন হয়, পিরিয়ড পূর্ববর্তী মুড সুইং, যা প্রি মিন্সট্রুয়াল সিম্পটম নামে পরিচিত; সেটা হলে রোগীকে কিছু ওষুধ, সাথে কিছু নিয়ম মেনে চলা ও কাউন্সিলিং করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এভাবে মুড সুইংয়ের কারণ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আর নিম্নের নিয়ম মেনে চললে মুড সুইং থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেতে পারেন।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
১. পর্যাপ্ত ঘুম। দৈনিক অন্তত ৭—৮ ঘণ্টা।
২. প্রতিদিন ২—৩ লিটার পানি পান করতে হবে।
৩. সঠিক ডায়েট মেনে চলা।
৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে।
৫. পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
৬. পরিবারের ও কাছের লোকদের সাথে নিজের এই সমস্যা নিয়ে আলাপ করা, নিজের মুড সুইং কখন কীভাবে হয়, সেটা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া।
মুড সুইংয়ের কারণে অতিরিক্ত রাগ কিংবা নেতিবাচক অনুভূতি মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ সমস্যা আপনার জীবনকে যদি কষ্টে ফেলে দেয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
সবটা শুনে আনান কেন জানি স্মিতার হাত ধরে ক্ষমা চাইলো। বললÑদোস্ত ভুল হয়ে গেছে, তোকে ভুল বুঝেছি, অনেক সময় না বুঝে তোকে নিয়ে উল্টা—পাল্টা মন্তব্য করেছি। ম্যাডামের কাছেই তোর মুড সুইংয়ের চিকিৎসা নিবো, আমি আর ইতি থাকব তোর সাথে। বন্ধুদের সাপোর্ট পেয়ে এক ফোঁটা আনন্দাশ্রু যেন গড়িয়ে পড়লো স্মিতার চোখ থেকে।