ডা. মিউরিন হোসেন
ফেইজ বি রেসিডেন্ট,চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিএসএমএমইউ।
একটা সময় বিকেল হলেই শিশুরা চলে যেত বাড়ির পাশের মাঠে। ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুটসহ বিভিন্ন খেলায় মত্ত থাকত তারা। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন মাঠের অভাবে শিশুরা খেলছে বাড়ির গ্যারেজে কিংবা রাস্তার গলিতে। তাদের দিন কাটে এখন কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে গেম খেলে।
শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠের বিকল্প অন্য কিছু আছে কি-না, আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের শিশুরা যেন বেড়ে উঠছে ফার্মের মুরগির মতো।
রাজধানীর আলো ঝলমলে এলাকাগুলোতে এভাবেই বেড়ে উঠছে শিশুরা। শহরে খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার অভাব। যার কারণে শিশুরা পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না।
জাতিসংঘের শিশু সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ রক্ষা ও সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। জাতীয় শিশুনীতি ও শিক্ষানীতিতেও শিশুর বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য অনেক কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। সুযোগ সৃষ্টি তো হচ্ছেই না, যেটুকু সুযোগ আছে, সেটা রক্ষা করা যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার খোলা মাঠের প্রয়োজন। কিন্তু সর্বশেষ এক হিসাবে ঢাকায় জনপ্রতি দশমিক ১ বর্গমিটারেরও কম মাঠ রয়েছে। কিন্তু ইট-পাথরের নগরায়ণের জাঁতাকলে হারিয়ে যাচ্ছে, একের পর এক খোলা মাঠের প্রাণ। খেলার মাঠের উন্মুক্ত জায়গা কিংবা বেশিরভাগ পার্ক, যতটুকু আছে সেটাও যেন যায় যায়। প্রাণজাগানিয়া মাঠের দৃশ্য যেমন চেনে না নতুন প্রজন্ম, তেমনি মাঠের খেলার স্বাদ বঞ্চিত হয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে চার দেওয়ালের ঘরবন্দি মানুষের মতো। দূরন্ত শৈশবের বদলে জড়তার অন্ধকারে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ।
শুধু শারীরিক নয়, একাধারে শিশুর মানসিক, সামাজিকও ভাষাগত বিকাশের ক্ষেত্রেও খেলার ভূমিকা স্বীকার না করলেই নয়। খেলার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, সামাজিক জ্ঞানবোধ, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়। খেলার মাধ্যমে শিশু তার আত্মকেন্দ্রিক জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমেই সামাজিক হয়ে ওঠে। শিশুর মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতার বিকাশও ঘটতে থাকে খেলার মাধ্যমে।
গত ২২ বছরে ঢাকায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা ১৫০টি থেকে নেমে এসেছে ২৪টিরও নিচে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির উন্নয়ন কাজ চলছে, আবার কোনোটি পরে থাকছে তালাবদ্ধ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০১৬-৩৫-এর জন্য প্রস্তাব তৈরিতে করা জরিপ মতে, ঢাকা মহানগরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। সেখানে নগরের প্রত্যেক সাড়ে ১২ হাজার মানুষের বিপরীতে একটি দুই একরের খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি মেয়রেরও সেই প্রস্তাবনা অনুযায়ী নগরের পরিকল্পনা করার কথা। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন নতুন মাঠের দিকে নজর না দিয়ে যেগুলো বিদ্যমান আছে, সেখানে কিছু উন্নয়ন কাজ করে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে দিচ্ছে। একইসঙ্গে পার্ক ও খেলার মাঠের প্রকল্প নিয়ে কাজ করায় আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে মাঠের পরিধি।
আমাদের রাষ্ট্রের আন্তরিকভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, শিশু-কিশোরদের জন্য যদি আমরা উপযুক্ত পরিমাণ খেলার জায়গা না তৈরি করতে পারি, তবে খেলাধূলাবিহীন দৈহিক ও মানসিকভাবে দুর্বল, পঙ্গু, বিপর্যস্ত, পথহারা, দিগভ্রান্ত প্রজন্মের জন্য একটি এলাকায় একটি থানা কখনোই পর্যাপ্ত হবে না।
শিশুদের অপূর্ণ মানসিক বিকাশের ফল এরই মধ্যে আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি। কিশোরদেরও ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর প্রায়ই পত্রিকার পাতায় আসছে। বেড়েই চলছে অসহিষ্ণুতা। মানসিক সুস্থ বিকাশের অভাবে তরুণরা জড়িয়ে পড়ছেন জঙ্গিবাদসহ নানা সহিংস কর্মকাÐে। এছাড়াও নগর এলাকায় সুস্থ বিনোদনের অভাবে শিশু-কিশোরদের অনেকেই মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাংসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে; অনেকেই অবষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। শুধু থানা বা জেলখানা নির্মাণের মাধ্যমে এ ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে না।
যে দেশ গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রাখে; কিন্তু শিশুদের খেলার জন্য জায়গা রাখে না। যে দেশের মানুষের কাছে শিশুর চেয়ে গাড়ি অগ্রাধিকার বেশি, সেই দেশ তো ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাবে-এটাই স্বাভাবিক। যার কারণে শিশুদের আক্রোশ ও স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও সহানুভূতিশীল আচরণ সাংঘাতিকভাবে তিরোহিত হচ্ছে, চলে যাচ্ছে।
আমরা যদি এখনও শিশুদের মাঠে নিয়ে যেতে না পারি, মাঠগুলো যদি শিশুদের জন্য উপযোগী করে দিতে না পারি, তবে কিন্তু আরও বড় বিপদ ঘনিয়ে আসবে।
কাজেই রাজধানীসহ সারাদেশে খোলা জায়গা রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। খেলার মাঠ ও পার্ক অপদখলের বিরুদ্ধেও নেওয়া প্রয়োজন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কোনো সরকারি খোলা জায়গায় যেন বস্তি গড়ে না ওঠে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের অধিকার রক্ষাই শুধু নয়, রাজধানীতে স্বস্তিকর পরিবেশ বজায় রাখতেই পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার। সিটি করপোরেশনের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ। আর সব মাঠকে দখলদারমুক্ত করে বিনোদনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারেরই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে রাষ্ট্র সময়োপযোগী ব্যবস্থা নেবেন বলে আমার প্রত্যাশা।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
- চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
মগবাজার রেইল গেইট।
নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
(ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০ - আরো পড়ুন- MK4C-তে কীভাবে টেলিসাইকিয়াট্রি চিকিৎসা নেবেন?