খেলাধুলার ইতিহাস সুুপ্রাচীন। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে চীনে প্রথম জিমনাাস্টিক্সের মাধ্যমে খেলাধুলার প্রচলন ঘটে। কয়েক হাজার বছর আগে মিশরেও বেশ কিছু খেলার উৎপত্তি হয়। তখন থেকেই খেলাধুলা বিনোদনের উপায় হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে যার প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্য বা মনের ওপর যথেষ্ট। কেমন সেই প্রভাব? আর কেনই বা সেই প্রভাব? আসুন জেনে নেয়ার চেষ্টা করি।
মাঠের খেলা, ব্রেইনের খেলা
খেলাধুলা বা শরীর চর্চায় আমাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন ও হ্যাপি কেমিক্যালএন্ডরফিন নামক রাসায়নিকের পরিমাণ বাড়ায়, যা সুখানুভূতি দেয় ও হতাশা, বিষণ্ণতা বা অস্থিরতা কাটাতে সাহায্য করে।
খেলা বাড়ায় আত্মবিশ্বাস
যেকোনো বহিঃকক্ষ ক্রীড়া বা আউটডোর গেমস মানুষকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে আসে যা মনকে চনমনে করে তোলে। পাশাপাশি যেকোনো ক্রীড়ানৈপুণ্য মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। একজন খেলোয়াড় নিজেকে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, নিজের ভূমিকা, নিজের শক্তি বা দুর্বলতা সম্পর্কে জানে।
খেলা ক্রোধ বা রাগ ভুলতে শেখায়
যখন কেউ খেলায় গভীর মনঃসংযোগ স্থাপন করে এবং খেলাটাকে উপভোগ করে তখন সে তার ব্যক্তিগত চাপ বা অস্থিরতা থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। যারা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তারা রেগে গেলে বা কষ্টের কোনো অনুভ‚তি হলে তা প্রশমন করার জন্য খেলার মাঠে যেয়ে হালকা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিতে পারেন। খেলায় খেলায় হারিয়ে যাবে সব যন্ত্রণা।
চাই খেলার মাঠ, চাই নেশামুক্ত তারুণ্য
খেলাবঞ্চিত ছেলেটি মন খারাপ হলে বা রাগ হলে কিছুই করার খুঁজে পায় না, তখন ভাবে-একটু নেশা করি, আনন্দ পাব। তার জন্য আমরা কোনো খেলার মাঠ রাখিনি। সে খেলার আনন্দ নেয়নি কখনো। হয়ত সে খেলার আনন্দ পেলে নেশার আনন্দ খুঁজে বেড়াত না কখনো। তাই খেলাধুলা অনেক সময়ই অনিয়ন্ত্রিত আবেগের একটি উত্তম সমাধান। খেলাধুলার অবারিত সুযোগ আর নিয়মিত অংশগ্রহণ তরুণ সমাজকে নেশার গ্রাস থেকে বাঁচাতে পারে।
খেলা বাড়ায় সামাজিক দক্ষতা
নিজ দলের এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে কথোপকথন, যোগাযোগ, কুশল বিনিময়, এবং প্রশিক্ষণ একজন খেলোয়াড়ের সামাজিক দক্ষতা বাড়ায় নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি একটি গ্রুপে অবস্থান করলে গ্রুপের বাকি সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি বেড়ে যায় বহুগুণে যার সুপ্রভাব ব্যক্তিজীবনে বা পারিবারিক জীবনে পড়ে।
খেলা চাপ নিতে শেখায়
একজন খেলোয়াড় যখন তার পিছিয়ে পড়া দলকে টেনে তোলার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে থাকেন আর প্রতিপক্ষ তাকে রীতিমত চেপে ধরে রাখে তখন তার স্নায়ুর চরম পরীক্ষা হয়। একের পর এক এমন পরীক্ষা দিতে দিতে একসময় তিনি শিখে যান কীভাবে চাপ সামাল দিতে হয়, কীভাবে ঠান্ডা মাথায় চাপ জয় করতে হয়।
খেলোয়াড়সুলভ আচরণ
খেলোয়াড়দের মাঝে থাকে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব যা সুস্থ, সুন্দর খেলার অংশবিশেষ। এতে দলীয় সঙ্গীর সাথে সৌজন্যপূর্ণ আচরণের অভ্যাসসহ প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের নৈতিক আচরণ, স্বাধীনতা এবং জয়ী বা পরাজিত হলেও ব্যক্তি বা দলকে সম্মান দেখানোর মানসিকতা গড়ে ওঠে।
খেলা ও জীবন
খেলায় জয়-পরাজয় আছে। দিনশেষে হয় জয় নয় পরাজয়, এই তো? একজন খেলোয়াড় হারলে ঠিকই কষ্ট পান কিন্তু হার মেনে নেন একটা সময়। আবার আশায় বুক বাঁধেন, পরের ম্যাচে ঠিকই ঘুরে দাঁড়াব। ঠিক তেমনি জীবনকে একইভাবে যদি দেখা যায় তাহলে না পাওয়ার কষ্ট বা হতাশা মানুষকে গ্রাস করতে পারবে না।
খেলায় কাটে অনিদ্রা
নিয়মিত খেলাধুলায় কেটে যায় অনিদ্রা সমস্যা। গভীর ঘুম এনে দিতে পারে একটি সুন্দর সকাল আর প্রশান্ত মন।
গবেষণা কী বলে?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খেলাধুলা ওবং শরীরচর্চা রীতিমত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধের মতো কাজ করে। কয়েকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, ঔষধের পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলা বিষণ্ণতার চিকিৎসাকে জোরদার করে এবং বারবার বিষণ্ণতা ফিরে আসতে বাধা দেয়। আবার বিভিন্ন গবেষণা এরকম বলে যে, যারা একটু নার্ভাস প্রকৃতির বা চাপ কম নিতে পারে, খেলাধুলায় তাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য।
গবেষণায় এমন চিত্রও দেখা গেছে যে, খেলায় আছে ঝুঁকি, আছে ইনজুরি, আছে ব্যথা, আছে অপারেশন যা অনেকসময়ই একজন খেলোয়াড়কে চাপে ফেলে দেয়। সেই চাপ কখনো কখনো তাকে বিষণ্ণ করে ফেলে যা পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ারের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিটি খেলোয়াড় যখন কোনো ইনজুরিতে পড়েন, কিছু বিষয় লক্ষ করা জরুরি। ইনজুরি পরবর্তী সময়ে তিনি সঠিকভাবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তো? ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তিটা তিনি হারিয়ে ফেলেননি তো?
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত।