মাইগ্রেনের সাথে মানসিক চাপের সংযোগ: কীভাবে প্রভাবিত করে মন?

0
25
মাইগ্রেনের সাথে মানসিক চাপের সংযোগ: কীভাবে প্রভাবিত করে মন?

ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

মাইগ্রেন এক ধরনের মাথাব্যথা যা প্রায়ই তীব্র এবং ভয়ংকর। এটি সাধারণত মাথার একপাশে অনুভূত হয় এবং কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যাঁদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে তাঁরা জানেন ব্যথা উঠলে কেমন লাগে। আবহাওয়া পরিবর্তনেই হোক কিংবা কড়া রোদ- অল্পতেই জেঁকে বসে মাইগ্রেনের ব্যথা। মাসের তিন চারদিন ব্যথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে চলে যায়। আবার কারো কারো মাসে কয়েকবার মাইগ্রেনের ব্যথা হয়। এতে কোনো কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যথা হলে অনেকের মাথা দপদপ করে। কারো আবার একপাশ থেকে ব্যথা অন্যপাশে স্থানান্তরিত হয়।

মাইগ্রেনের লক্ষণসমূহ:

মাথাব্যথা: মাইগ্রেনের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো মাথাব্যথা। এই ব্যথা সাধারণত ধড়ফড়ানো বা ধাক্কা খাওয়ার মতো অনুভূত হয়।

অন্যান্য লক্ষণ: মাথাব্যথার সাথে অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে, যেমন:

  •    বমি বমি ভাব বা বমি
  •    আলো বা শব্দে সংবেদনশীলতা
  •    চোখে ঝাপসা দেখা
  •    অসাড়তা বা ঝিনঝিন অনুভূতি
  •    একপাশে শরীর জাড়া দেওয়া
  •    ঘাড়ে ব্যথা
  •    মেজাজ খারাপ

Magazine site ads

মাইগ্রেন কেন হয় : মাইগ্রেনের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে চিকিৎসকেরা বলেন, এই ধরনের ব্যথা জিনগত। পরিবারের কারো মাইগ্রেন  থাকলে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, মস্তিষ্কের রক্তনালী, স্নায়ু এবং রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার কারণে মাইগ্রেন হয়। কিছু বিশেষ জিনিস মাইগ্রেনের আক্রমণকে ত্বরান্বিত করতে পারে, এগুলোকে ট্রিগার বলা হয়। সাধারণ কিছু ট্রিগার যেমন-

১. মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রম : যখন স্নায়ু ব্যবস্থা, শরীরের রাসায়নিক উপাদান এবং রক্তনালিকে আক্রান্ত করে ফেলে, তখনই এই ধরনের তীব্র ব্যথা মাথার একপাশে অনুভূত হয়। মনে করা হয়, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রম মাইগ্রেন হওয়ার বড় কারণ।

২. হরমোনজনিত পরিবর্তন : চিকিৎসকদের মতে ঋতুচক্রের সময়  মাসিকের আগে, গর্ভাবস্থা এবং মেনোপজের সময় নারীরা বেশি মাইগ্রেনে ভোগেন। আবেগ বা অন্যান্য কারণ ও মাইগ্রেনের পেছনে ভূমিকা রাখে। যেমন: মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হঠাৎ পাওয়া আঘাত ইত্যাদি।

৩. শারীরিক কারণ: শারীরিক বিভিন্ন কারণেও অনেক সময় মাইগ্রেন হতে পারে। যেমন: ঘুম কম হওয়া বা রাতে ঘুম না হওয়া, হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা ইত্যাদি।

৪. পরিবেশগত কারণ : পরিবেশগত কারণেও মাইগ্রেন হতে পারে। কেউ যদি হঠাৎ করে গরম থেকে ঠান্ডা বা ঠান্ডা থেকে গরম পরিবেশে যান তাহলে  হঠাৎ করে মাইগ্রেনের সমস্যা শুরু হতে পারে৷ উজ্জ্বল আলো, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি কারনেও মাইগ্রেন হতে পারে।

৫. খাবার : আমাদের খাদ্যাভ্যাসও অনেক সময় মাইগ্রেন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। খাবারে অনিয়ম করা, পানিশূন্যতায় ভোগা, মদ্যপান করা, অতিরিক্ত চা বা কফি পান করা এসব নানা ধরনের অনিয়ম মাইগ্রেন হওয়ার পেছনে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে।

মাইগ্রেনের ধরন এবং মানসিক চাপ:

মাইগ্রেনের বিভিন্ন ধরন আছে এবং প্রত্যেক ধরনের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্ক আলাদা হতে পারে।

  • অরা (aura) মাইগ্রেন: এই ধরনের মাইগ্রেনে মাথাব্যথার আগে কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন আলো দেখা, শব্দ শোনা, অথবা শরীরের কোনো অংশ জাড়া দেওয়া। এই ধরনের মাইগ্রেনে উদ্বেগ ও চিন্তা বেশি হতে পারে।
  • অরা (aura) বিহীন মাইগ্রেন: এই ধরনে মাথাব্যথার আগে কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। তবে মানসিক চাপ এই ধরনের মাইগ্রেনের একটি প্রধান ট্রিগার হতে পারে।
  • মাইগ্রেন এবং মানসিক চাপ: মাইগ্রেন এবং মানসিক চাপের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রায়শই দেখা যায়, মানসিক চাপ মাইগ্রেন আক্রমণের একটি প্রধান ট্রিগার। কীভাবে মানসিক চাপ মাইগ্রেনকে প্রভাবিত করে:
  • আক্রমণের ঘন ঘনতা: মানসিক চাপ মাইগ্রেন আক্রমণের ঘন ঘনতা বাড়িয়ে তোলে। চাপের মাত্রা যত বেশি, আক্রমণের সম্ভাবনা তত বেশি।
  • ব্যথার তীব্রতা: মানসিক চাপের সময় মাইগ্রেনের ব্যথা সাধারণত আরও তীব্র হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে।
  • অন্যান্য লক্ষণ: মানসিক চাপের সাথে মাইগ্রেন আক্রমণের সময় অন্যান্য লক্ষণ যেমন বমি বমি ভাব, আলো ও শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা আরও খারাপ হতে পারে।
  • ধারাবাহিক চক্র: মাইগ্রেনের ব্যথা নিজেই মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা আবার নতুন করে মাইগ্রেন আক্রমণের কারণ হতে পারে। এইভাবে একটি ধারাবাহিক চক্র তৈরি হয়।

মনের খবর ম্যগাজিনে

কেন মানসিক চাপ মাইগ্রেনকে প্রভাবিত করে:

  • রাসায়নিক পরিবর্তন: মানসিক চাপের সময় শরীরে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা পরিবর্তিত হয় যা মাইগ্রেনের আক্রমণকে ট্রিগার করতে পারে।
  • রক্তবাহী নালীর সংকোচন: মানসিক চাপ রক্তবাহী নালীকে সংকুচিত করে, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কম করে এবং মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়াতে পারে।
  • দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনের ক্রমাগত ব্যথা হতাশা, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার  দিকে পরিচালিত করতে পারে যা  গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা সুযোগগুলি হাতছাড়া করার ভয়ও সৃষ্টি করতে পারে।বিষণ্নতা মাইগ্রেনের পরিণতি এবং ট্রিগার উভয়ই হতে পারে, একটি চক্রাকার প্যাটার্ন তৈরি করে যা মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে।
  • হতাশা এবং অসহায়ত্ব: মাইগ্রেনের সূত্রপাত নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা হতাশা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
  • উদ্বেগ এবং ভয়: দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরবর্তী মাইগ্রেনের আক্রমণের পূর্বাভাসের সাথে উদ্বেগ এবং ভয়ের বিকাশ ঘটাতে পারে।
  • বিষণ্নতা এবং বিচ্ছিন্নতা: মাইগ্রেনের দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনে তাদের প্রভাব দুঃখ এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

মাইগ্রেন এবং মানসিক চাপ মোকাবেলা করার উপায়:

  • স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: ধ্যান, যোগব্যায়াম, শ্বাসক্রিয়া ব্যায়াম ইত্যাদি স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক অনুশীলন করুন।
  • সুষম খাদ্য: সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
  • শারীরিক ব্যায়াম: নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ: মাইগ্রেন এবং মানসিক চাপের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা: একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা মাইগ্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতাকে প্রভাবিত করতে পারে, মানসিক সুস্থতা এবং মাইগ্রেনের লক্ষণগুলির মধ্যে একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক তৈরি করে।

১. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: স্ট্রেস মাইগ্রেনের জন্য একটি সাধারণ ট্রিগার, এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট আক্রমণের ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে সাহায্য করতে পারে। যোগব্যায়াম বা শিথিলকরণ দৈনন্দিন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

২. কগনেটিভ বিহেবিয়ার বা জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (CBT): CBT হল একটি প্রমাণ-ভিত্তিক থেরাপিউটিক পদ্ধতি যা ব্যক্তিদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনার ধরণ এবং আচরণগুলি সনাক্ত করতে এবং পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। CBT দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনের রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে, কারণ এটি উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মোকাবেলার কৌশলগুলিকে শিখতে ও জানতে সাহায্য করে।

৩. ঔষধ এবং মানসিক স্বাস্থ্য : দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনের চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধ মানসিক স সাধারণত মাইগ্রেনের ব্যথায় ‘পেইনকিলার’ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যথার ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

৪. আয়ুর্বেদ মতে, এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু ঘরোয়া টোটকাও রয়েছে। এই ভেষজ পানীয় হিসাবে পান করলে মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় আরাম মিলবে।

  • আদা ও হলুদের চা : মাইগ্রেনের ব্যথাসহ যেকোনো মাথাব্যথা এমনকি মানসিক চাপে আদা ও হলুদের চা বেশ কার্যকর। এই দুটি ভেষজেরই প্রদাহনাশক গুণ রয়েছে, যা মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পানিতে কয়েক টুকরো আদা ও কাঁচা হলুদ ফুটিয়ে পানীয় তৈরি করে নিন। চায়ের মতো করেই সকাল-সন্ধ্যায় এ পানীয় পান করুন।
  • পুদিনা ও ক্যামোমাইল চা: পুদিনা ও ক্যামোমাইল চায়ে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা স্নায়ুর উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পুদিনা মাথা ও ঘাড়ের পেশি শিথিল রাখে। অন্য দিকে ক্যামোমাইল মানসিক চাপ দূর করে। গরম পানিতে কয়েকটি পুদিনা পাতা ও ক্যামোমাইল ফুলের শুকনো পাপড়ি ফুটিয়ে সেই পানীয় পান করুন।  মাইগ্রেনের ব্যথা বশে থাকবে।
  • ল্যাভেন্ডার ও লেবুর রস : মাইগ্রেন ও মাথাব্যথায় আরাম পেতে ল্যাভেন্ডার চায়ের মধ্যে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। ব্যথা ও মানসিক চাপ কমাতে এই পানীয়টি  বিশেষ ভাবে কাজ করে। ল্যাভেন্ডার মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। লেবুর তাজা ঘ্রাণ মন ফুরফুরে রাখে।

মাইগ্রেন এবং মানসিক চাপ একটি জটিল সমস্যা। সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে একে মোকাবেলা করা সম্ভব।

আরও পড়ুন-

Previous articleসাইকিয়াট্রি বিভাগের এপ্রিল মাসের বৈকালিক আউটডোর সূচি
Next articleরাতে ঘুমাতে পারি না, সবসময় এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here