স্বাভাবিক চঞ্চলতা প্রতিটি শিশুর বৈশিষ্ট্য। তাই বলে শিশুদের অতি চঞ্চলতা কি স্বাভাবিক? অতি চঞ্চলতা একটি মস্তিস্কের বিকাশ জনিত রোগ যা “এটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজর্ডার” সংক্ষেপে এডিএইচডি বা মনোযোগহীনতা ও অতি চঞ্চলতা রোগ নামে পরিচিত । এই সমস্যা শিশুদের মনোযোগের অভাব ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণের সমস্যা থাকে এবং তারা অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে থাকে । সাধারনত দেড় দুই বছর বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে এই রোগ শনাক্ত হওয়া শুরু হয় যা অনেক সময় শিশু স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না । গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বের ১৮ বছরের নিচে এই রোগে ভোগা শিশুদের সংখ্যা ১২৯ মিলিয়ন বা ৭.২ ভাগ যা কিনা স্কুলে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ১০০ জনে ৫ জন । আর বড়দের মধ্যে এই রোগে আত্রান্তের হার শতকরা প্রায় ২.৫ভাগ । ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের মাত্রা মেয়ে শিশুদের তুলনায় ৩ গুন।
এডিএইচডি রোগে আক্রান্তদের মধ্যে এর লক্ষণ সাধারণত বাড়ি ছাড়াও অন্য স্থানে যেমন: স্কুল,আত্নীয়, প্রতিবেশির বাসা, এমনকি খেলার মাঠেও একটানা ৬ মাসের বেশি সময় ধরে দেখা যায় এবং এর ফলে শিশুর পারিবারিক, সামাজিক এবং লেখা পড়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে । সাধারণত এই রোগে তিন ধরনের সমস্যা দেখা যায় । যেমন:
১. মনোযেগের অভাব
২. অতিচঞ্চলতা
৩. হঠাৎ কিছু করে ফেলার প্রবণতা
মনোযোগের অভাব: এডিএইচডি রোগে আক্রান্তরা কোন কাজে বা খেলায় মনোযোগ দিতে বা ধরে রাখতে পারে না। মনোযোগ দিয়ে কোন কথা শোনে না বা নির্দেশ অনুযায়ী অর্পিত কাজ বা দায়িত্ব পালন করতে পারে না । তারা খুব সহজে ভুল করে ফেলে কিংবা প্রায় প্রতিদিনের কাজের কথা ভুলে যায়। স্কুলের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম(যেমন: পেন্সিল,বই,খাতা,খেলনা,অথবা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) প্রায়ই হারিয়ে ফেলে।তারা খুব সহজেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। কাজ শুরু করতে যেমন: কঠিন মনে করাতে একটি কাজ ঠিকমত শেষ না হতেই আরেক কাজে চলে যায়।
অতিচঞ্চলতা: এডিএইচডি রোগে আক্রান্তরা অতিরিক্ত অস্থির থাকে,লাফালাফি করে,গা–হাত মোড়ামুড়ি করে, এবং কোন জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না। অবসর সময়ে বা খেলাধুলায় স্থির থাকতে পারে না এমনকি নিষেধ আছে এমন স্থানেও দৌঁড়ে বেড়ায় , লাফালাফি করে। গোলমাল না করে খেলায় বা বিনোদন মূলক কোন কিছুতে অংশগ্রহণ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
হঠাৎ কিছু করে ফেলার প্রবণতা: এডিএইচডি আক্রান্তরা হঠাৎ করেই আনাকাঙ্ক্ষিত কোন কিছু করে ফেলে; যেমন –কাউকে মারা ,ঢিল ছোঁড়া, গালি দেওয়া, কোন কিছু ভেঙে ফেলা, ছিঁড়ে ফেলা বা নষ্ট করা । তারা ভবিষ্যৎ ফলাফল চিন্তা না করেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হুট করে নিয়ে ফেলে। অন্যদের কথার মাঝে নাক গলায়, তাকে থামতে বলা হলেও বা কেউ না শুনলেও সে প্রায়ই বলতেই থাকে। খেলাধুলায় তার পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । এবং প্রশ্ন ভালভাবে শোনার আগেই চিন্তাভাবনা না করে একটা কিছু উত্তর দেয়।
রোগের কারণ:
এডিএইচডি রোগের কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণ নেই। এটি মূলত মস্তিস্কের বিকাশজনিত সমস্যা। স্বাভাবিকভাবে মস্তিস্কের কিছু অংশ অন্য অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরোগে এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যহত হয়। তবে নানা কারণে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যহত হতে পারে, তার মধ্যে বংশগত কারণে শতকরা ৭৫ ভাগের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ থাকে। জন্মের সময় আঘাত, বাচ্চার ওজন কম হওয়া, মাতৃত্বকালীন সময়ে নেশা দ্রব্য যেমন-মদ্যপান বা ধূমপান করলে, গর্ভাবস্থায় অন্য কোন শারীরিক অথবা মানসিক সমস্যা ছাড়াও ছোটবেলায় কীটনাশক বা লেডএর সংস্পর্শে আসা এবং মস্তিস্কে রাসায়নিক পদার্থের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণেও এডিএইচডি হয়ে থাকতে পারে।
এডিএইচডি রোগের কারণে যা হতে পারেঃ
মস্তিস্কের বিকাশজনিত সমস্যার সাথে সুষ্ঠু পরিবেশে শিশু বেড়ে না উঠলে এ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠতে পারে । অনেক বেশি টেলিভিশন দেখলে, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত বা লবণাক্ত খাবার ,প্রক্তিয়াজাত খাবার ফাস্ট ফুড (Fast Food), খাদ্য সংরক্ষণের উপাদান যুক্ত খাবার ,রং মেশানো খাবার কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, চকলেট ইত্যাদি খেলে , বড় ধরনের মানসিক আঘাত পেলে । সন্তানের প্রতি মা- বাবার আচরণে সমস্যা থাকলে (যেমন- অতি মনোযোগিতা ,অতি উদাসীনতা ,শিশুপালনে মা –বাবার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা ইত্যাদি) এই সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
এই ধরনের শিশুদের সাথে সমবয়সী শিশুরা খেলতে অপছন্দ করে বলে শিশুটি হয়ে পড়ে বন্ধুহীন । লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি যেকোন বিনোদন মূলক কাজও তার দ্বারা ঠিকভাবে হয়ে উঠে না । তার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পারিবারিক সকল কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা আত্নীয় -বন্ধু পরিমন্ডলে শিশুটিকে নিয়ে বিব্রত বোধ করেন তার বাবা মা । একপর্যায়ে শিশু নিজেও তার সমস্যার কথা বুঝতে পারে , তবে কেন এইরকম হয় তা সে বুঝে উঠতে পারে না।
এছাড়া এই রোগের সাথে কখোনো কখনো অন্যান্য মানসিক রোগও পাওয়া যায় । প্রাথমিক অবস্থায় যেসব মানসিক রোগ থাকতে পারেঃ অটিজম , টিক ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার ইত্যাদি । এই রোগ দীর্ঘমেয়াদী হলে কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার,অপজিশনাল ডেফায়েন্ট ডিজঅর্ডার,উদ্বেগআধিক্য রোগ,বিষণ্ণতা’সহ নানা ধরনেরমানসিক রোগ দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা না নিলে কি হতে পারে:
এই রোগে আক্রান্তরাও ভবিষ্যতে সফলভাবে জীবনযাপন করতে পারে যদি সময়মত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। বিভিণ্ণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই রোগ দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে এবং এর সাথে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যেমন- শিশু বয়সে শুরু হয়ে শতকরা ৫০-৮০ ভাগ কিশোর বয়স পর্যন্ত এবং ৩৫-৬৫ ভাগ এর পরিণত বয়স পর্যন্ত এই রোগ থেকে যেতে পারে। একই সাথে অন্যান্য রোগ যেমন, অপজিশনাল ডেফায়েন্ট ডিজঅর্ডার (ODD) শতকার ৫০ ভাগ, কন্ডাক্ট এবং এন্টিসোশ্যাল ডিজঅর্ডার ২৫-৪৫ ভাগ, বুদ্ধির ঘাটতিজনিত সমস্যা ২০-৪০ ভাগ এবং বিষণ্ণতা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের সাথে শুরু হতে পারে।এডিএইচডি আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ১০-২৫ নেশার সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। শিশুদের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ এবং বড়দের মধ্যে শতকরা ১ ভাগ আত্মহত্যা করতে পারে। এব শতকরা ৩০-৫০ ভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের ফলাফল দিন দিন খারাপ হতে থাকে।
রোগ র্নিণয়:
এই রোগ র্নিণয়ে কোন সুর্নিদিষ্ট পরীক্ষা নেই। রোগী, রোগীর পরিবার, প্রয়োজনে স্কুলের শিক্ষক, খেলার সাথী, আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
চিকিৎসা:
এই রোগের চিকিৎসায় ঔষধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপীর ভূমিকাও গুরুত্বর্পূণ। ঔষধ মস্তিষ্কের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি সাইকোথেরাপীর মাধ্যমে শিশুর আচরণমূলক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এছাড়া পিতামাতাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা প্যারেন্টিং ট্রেইনিংও এডিএইচডি চিকিৎসার জন্য জরুরী। চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্কুলের শিক্ষক ও খেলার সাথীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বড়দের ক্ষেত্রে ফ্যামিলি কাউন্সেলিং ও সাপোর্ট বা সহায়তা চিকিৎসারই অংশ।
এডিএইচডি সমস্যা সমাধানে বি.এস.এম.এম.ইউ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের ক্লিনিকে এডিএইচডি এসব সেবা দেওয়া হয়।প্রতি রবিবার ১১:০০ হতে ১:০০ টা পর্যন্ত বি.এস.এম.এম.ইউ মনোরোগবিদ্যা বর্হিবিভাগে এই সেবা প্রদান করা হয়।