খ্যাতিমান গায়ক, গীতিকার ও সুরকার তিনি। বাংলা পপ গানের অন্যতম পথিকৃৎ। সঙ্গীতের জন্য পেয়েছেন দেশি বিদেশী অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননা। আবার দেশের প্রয়োজনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি জানে আলম। মনের খবর পাঠকের মুখোমুখি হয়ে এবার তিনি জানাচ্ছেন তাঁর মনের কথা, ভালোলাগার কথা, স্বপ্নের কথা, স্মৃতির কথা, ইচ্ছার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ মামুন।
মনের খবর: কেমন আছেন?
জানে আলম: আল্লাহ্র রহমতে ভালো আছি ইনশাল্লাহ।
মনের খবর: কীভাবে ভালো থাকেন?
জানে আলম: ভালো থাকার আগ্রহ বা ভালোভাবে বাঁচার আগ্রহটা মনের মধ্যে পোষণ করি।
মনের খবর: তবুও তো বিভিন্ন কারণ বা সমস্যা আমাদের খারাপ রাখতে পারে?
জানে আলম: হ্যাঁ তা পারে। তবে তাতে হতাশা প্রকাশ না করে আশাবাদী হতে হবে।
মনের খবর: কি আপনাকে বেশি ভালো রাখে?
জানে আলম: অবশ্যই সঙ্গীত। গান গাওয়া, গান লেখা, গান সুর করা এসবের মধ্যেই সবচাইতে বেশি থাকি।
মনের খবর: মন খারাপ হয়?
জানে আলম: না আমার তেমন মন খারাপ হয় না।
মনের খবর: তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক ঘটনা আমাদের একটু হলেও মন খারাপ করতে পারে?
জানে আলম: আমি এটাকে অন্যভাবে দেখি। আমাদের দেশের মানুষ এখনও শিক্ষাদীক্ষায় অতটা এগিয়ে যায়নি, এখানে সবার কাছেই আমি যদি ভদ্রচিত আচরণ আশা করি তাহলে সেটি হবে ভুল।
মনের খবর: রাগ হয়?
জানে আলম: হয়। তবে খুব সহজে আমি রাগি না।
মনের খবর: রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে?
জানে আলম: কারো উপর রাগ হলে মনে মনে ভাবি সে এটি বুঝতে পারছে না, তখন আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ্ তাকে সঠিক জিনিষ বোঝার তৌফিক দান করেন।
মনের খবর: গানে আসলেন কীভাবে?
জানে আলম: আমার বাবা ডা. সালাম খান চিকিৎসার পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া রেডিওর একজন ক্ল্যাসিক ঘরনার শিল্পী ছিলেন। তবে তিনি চাইতেন না তাঁর ছেলেরা কেউ গান শিখুন। সে কারণে আমার বোনেরা শুধু গান শিখতো। এদিকে আমার নিজেরও খুব ইচ্ছে গান শেখার, তাই উস্তাদজি যখন আমার বোনেদের গান শেখাতেন তখন লুকিয়ে লুকিয়ে সেই গান শেখানো দেখতাম এবং নিজে গাওয়ার চেষ্টা করতাম। এভাবেই আসলে গানের মধ্যে চলে আসি।
মনের খবর: এদেশে বাংলা গানের উত্তোরণ কতটুকু হয়েছে?
জানে আলম: আমি বলবো অভূতপূর্ব। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে আমরা দেখতাম গান বলতে বোম্বের হিন্দি গান, পাকিস্তানের উর্দু গান অথবা ভারতের পশ্চিম বাংলার গান বা গায়কেরাই ছিলেন বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেটির একটি আমূল পরিবর্তন আসে, দেশের সঙ্গীতশিল্পীগণ এবং দেশীয় সঙ্গীত দিনদিন জনপ্রিয় হতে থাকে। যে ধারাটি এখনও অব্যাহত রয়েছে।
মনের খবর: এটা হলো কীভাবে?
জানে আলম: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা এদেশের সঙ্গীতে একটা বিশেষ ধারার প্রচলনের চেষ্টা করি। বিশেষ করে আমি, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফিরোজ সাঁই এরা বাংলা গানের মধ্যে আরো বেশি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করতে থাকি। বিশেষ করে গীটার, ড্রামস ইত্যাদি বিশ্বনন্দিত বাদ্যযন্ত্রগুলোর সংমিশ্রণ ঘটাই যা এদেশের মানুষ বিপুল সমাদরে গ্রহন করে এবং বাংলা সঙ্গীতের ধারায় একটি আমূল পরিবর্তন ঘটায়।
মনের খবর: এটা নিয়ে কিছুটা সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষ করে আবহমান বাংলা গানের মধ্যে বিদেশী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে?
জানে আলম: বিশ্ব দরবারে পৌঁছাতে হলে সেটিকে বিশ্বমানের এবং সারা পৃথিবীর সঙ্গীতের সাথে সমন্ময় করেই করতে হবে। এমনকি সারা বিশ্বই এখন এটি করছে। বিশেষ করে এই সময় যখন একেক দেশের একেক জাতির মানুষ বা সঙ্গীত বোদ্ধারা অন্য দেশের সুর সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের সাথে পরিচিত হচ্ছে গ্রহণ করছে তখন আমাদের এখানে পিছিয়ে থাকার অবকাশ নেই।
মনের খবর: এতে বাংলাদেশের সঙ্গীত বিশ্বে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মনে করেন?
জানে আলম: অনেক। যখন বিদেশে অনুষ্ঠান করি এবং এই কিছুদিন আগেও আমেরিকা, কানাডা, জাপান ও মালয়েশিয়া টানা অনুষ্ঠান করে আসলাম। সেখানে দেখেছি বাংলাদেশের শ্রোতাদের পাশাপাশি বিদেশী শ্রোতা যারা থাকেন তাদের ভেতর বাংলা গানের প্রতি দারুণ এক ভালোলাগা কাজ করে। এবং তাদের এই অভিব্যক্তিই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের গান বিদেশে এখন অনেক অনেক জনপ্রিয়।
মনের খবর: ব্যক্তি জীবনে আপনার চাওয়া পাওয়ার দূরত্ব কতটুকু?
জানে আলম: সত্যি কথা বলতে জীবনে যা চেয়েছি তার চাইতে অনেক অনেক বেশি পেয়েছি। আমাকে দেশের মানুষ চেনে, জানে। দেশে বিদেশে অনেক বিখ্যাত লোকদের হাত থেকে পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছি, এদেশের গান নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াই। এর চাইতে বড় পাওয়া আমার কাছে আর কি হতে পারে!
মনের খবর: স্মৃতি কাতরতা আছে?
জানে আলম: হ্যাঁ, স্মৃতি কাতরতা তো আছেই।
মনের খবর: কোন স্মৃতিগুলো আপনাকে বেশি আলোড়িত করে?
জানে আলম: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক অপারেশনে আমার কাছের বন্ধু মাহফুজ শহীদ হয়। তখন আমি তার কাছেই ছিলাম। সে স্মৃতিটি ভীষণভাবে আমার বুকে গেঁথে আছে।
মনের খবর: ঘটনাটি আমাদের বলবেন কি?
জানে আলম: আমার বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পাকিস্তান আর্মির বেলুচ রেজিমেন্টের একটা গ্রুপ সেখানে অবস্থান নিয়েছিলো। এক রাতে আমরা সেই থানা আক্রমণ করি। অনেক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর প্রায় মাঝ রাতের দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। তারপর আমরা থানার দখল নেই। দখলের পরে রুম তল্লাশীর সময় যে রুমে আমি ঢুকতে চেয়েছিলাম সেটাতে মাহফুজ আগে ঢুকে যায় এবং তা দেখে আমি অন্য রুমের দিকে যাচ্ছি এমন সময় মাহফুজ যে রুমে ঢুকেছিলো সে রুমে পাকিস্তান আর্মিদের রাখা একটি অবিষ্ফোরিত বোমা ফেটে সেখানেই মাহফুজ শহীদ হয়। তারপর মাহফুজের লাশের পাশে বসে অনেক কেঁদেছিলাম।
মনের খবর: আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আপনার দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সবচাইতে বড় অর্জন কি?
জানে আলম: স্বাধীনতার স্বাদ, বিজয়ের স্বাদ। যে জাতি একবার এ স্বাদ পেয়ে গেছে সে জাতি আর কোনদিন পরাধীন থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ চিনিয়েছে। আরেকটি অর্জন হলো দৃঢ় মনোবল এবং প্রবল ইচ্ছেশক্তি থাকলে শত্রু যতোই শক্তিশালী হোক তার পরাজয় আবশ্যিক সেটি আমরা জেনে গেছি।
মনের খবর: আরেকটি জীবন পেলে কি করতেন?
জানে আলম: আরেকটি জীবন পেলেও গানের ভূবনেই থাকতাম। গানের মাঝে যতটা ভালো থাকি আর কিছুতেই অতটা ভালো থাকি না। আর চাইতাম দেশের প্রয়োজনে আবারো নিজেকে উৎসর্গ করতে।
মনের খবর: পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
জানে আলম:পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো আমিও আপনাদের মতো একজন বাংলাদেশি ও বাংলাভাষী। আমিও আপনাদের মতো বাংলায় কথা বলি, বাংলায় গান গাই। এর চাইতে আপন আমার আর কেউ নাই।
মনের খবর: মনের খবর পাঠকদের পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
জানে আলম: ধন্যবাদ মনেরখবরকেও।