বিয়োগশোক, তীব্র শোক ও শোক পালন

0
17
বিয়োগশোক, তীব্র শোক ও শোক পালন

অধ্যাপক কর্নেল ডা. জুলহাস উদ্দিন আহাম্মদ
এম.বি.বি.এস, এমফিল, এফ.সি.পি.এস এ্যাডভান্স কোর্স ইন সাইকিয়াট্রি (তুর্কি) উপ মহাপরিচালক, বর্ডার গার্ড হাসপাতাল, ঢাকা।

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শোক পালন প্রচলিত আছে। ঐতিহাসিক বর্ণনায় ইসলাম ধর্মে শোকের ইতিহাস মহানবী (সা.) সময়ের যেমন-হিজরী ৮ম শতাব্দীতে ও ওহুদের যুদ্ধের পর মদিনার নারীরা তাদের মৃত আত্মীয়দের জন্য শোক প্রকাশ করেছিল। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে কুবলার রস ও জর্জ বোনানোর শোক সম্পর্কিত ধারণা ও থিউরি মনোচিকিৎসা বিজ্ঞানে অধিক সমাদৃত এবং ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বেরিভমেন্ট বা বিয়োগশোক, গ্রিফ বা তীব্র শোক ও মোর্নিং বা শোক পালন করা তিনটি শব্দ একই রকম মনে হলেও মনোরোগবিদ্যায় এগুলো বিশেষ অর্থ বহন করে। এগুলো যেকোনো তাৎপর্যপূর্ণ বা অপূরণীয় ক্ষতিতে/ মৃত্যুতে এক ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়ারই বহিপ্রকাশ যা একটি নির্দিষ্ট মনোবৈজ্ঞানিক ধারা বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। মানব মনের জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার বাহ্যিক প্রতিফলনই বেরিভমেন্ট রিয়েকশন যা নিকটাত্মীয় বা আপনজনের মৃত্যুতে বা অন্তর্ধানে প্রকাশ পায়।

বিয়োগশোক বা বেরিভমেন্ট:

আক্ষরিক অর্থে বেরিভমেন্ট/ বিয়োগশোক বলতে মনের এমন একটা অবস্থা বুঝায় যা তাৎপর্যপূর্ণ বা অপূরণীয় মৃত্যুতে আবেশিত হয়ে মোর্নিং/শোক করার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

তীব্রশোক/ গ্রিফ: তীব্রশোক হলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক অনুভূতি যা নিকটাত্মীয় বা আপনজনের মৃত্যুতে বা ক্ষতিতে প্রকাশিত বা অনুধাবিত হয়।

মোর্নিং বা শোক করা গ্রিফের সমার্থক হলেও এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে গ্রিফ বা তীব্রশোক বাস্তবে প্রকাশ পায়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও স্থায়ী মানসিক চাপে এটি হয়ে উঠতে পারে অস্বাভাবিক বা জটিল।মনের খবর ম্যগাজিনে

বেরিভমেন্ট রিয়েকশন বা বিয়োগশোক প্রতিক্রিয়া সিনড্রোম:

এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যক্তি ক্ষেত্রে বিভিন্ন হলেও সামষ্টিক অর্থে এই প্রক্রিয়াগুলো মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনেই একটি নির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হয় বলেই একে সিনড্রোম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা নির্দিষ্ট চিহ্ন বা নির্ণয় প্রক্রিয়া ও নির্ধারিত কোর্স এবং প্রত্যাশিত সমাধান বা রিকভারি সম্ভব। কোনো কারণে যদি এটি অসম্ভব হয় তবে তা জটিল হয়ে পড়ে। তখন এটি ব্যক্তি বিশেষের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে তার কাজ
কর্মে ব্যঘাত ঘটায়। শোক সাধারণত দুই ধরনের:

১। স্বাভাবিক শোক

২। জটিল শোক/কমপ্লিকেটেড: এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে বিষণ্ণতায় রূপ নেয়।

স্বাভাবিক শোক:

এটি সরল বা অজটিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যাতে বিভিন্ন ফেজ বা অধ্যায় থাকে। এটি যেমন-প্রতিক্রিয়া ধর্মীয় উৎস হতে উৎপন্ন হয় তেমনি এটি আবার তার প্রভাব বা বলয় ফেলে নিপতিত হয়। এর তিনটি অধ্যায়/ফেজ রয়েছে।
অধ্যায়-১: শক/বিমর্ষতা/মূর্ছা/ সংক্ষোভ/অভিঘাত/মর্মাহত।
অধ্যায়-২: মৃত ব্যক্তির স্মৃতিতে আচ্ছন্ন আবিষ্ট থাকা/ শোকাচ্ছন্ন থাকা।
অধ্যায়-৩: স্বাভাবিক নিপতন বা রেজুলেশন বা সমাধান।
স্বাভাবিক শোকের লক্ষণ বা চিহ্ন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন আবেগীয় বা ইমোশনাল, শরীর বৃত্তীয় বা সোমাটিক চিন্তাগত, চিন্তাপ্রসূত এবং মোটিভেশনাল বা প্রেষণাগত।
প্রত্যেক সমাজেই স্বাভাবিক শোক প্রকাশের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া বা আচরণ নির্দিষ্ট আছে, যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে প্রাগৈতিহাসিকভাবে প্রত্যেক সমাজ বা কালচারে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, কাঠামো/ কাস্টম এবং আচরণ নির্ধারিত আছে। এর প্রতিফলন আমরা বিয়োগশোক বা বেরিভমেন্ট প্রক্রিয়ায় দেখতে পাই। বিভিন্ন ভার্চুয়াল/ ধর্মীয় ইভেন্ট, ফিউনেরাল এবং সমাধি প্রক্রিয়া এই তীব্র শোককে সহায়ক সমাপ্তকরণ ও ভুলে থাকতে সর্বদাই মানবকুলকে স্থিরিকরণে সহায়তা করে-অগোচরে মেনে নেয়ার মানসিক প্রবণতাকে উত্তরণ করে শোকের সীমানা নির্ধারণ করে।

বিয়োগশোক থেকে বিষণ্ণতা:

স্বাভাবিক শোক প্রক্রিয়া যখন দীর্ঘস্থায়ী হয় বা এর প্রকাশভঙ্গি যখন অতি তীব্র হয় তখন অন্যান্য স্ট্রেস/মানসিক চাপ ও কোপিং ক্যাপাসিটি ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে নির্ধারণ করত: বিষণ্ণতার উদ্রেক করতে পারে। তাই অতিশোক প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। শোক প্রকাশে লিমিট সেটিং বা বাউন্ডারির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

শোক থেকে শক্তি: সুইচ-আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট এলিজাবেড কুবলার-রস ও কলম্বিয়া সাইকোলজিস্ট জর্জ বোনানোর থিউরি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় কীভাবে আমরা শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারি বা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। তাদের দেখানো শোকের পাঁচটি ধাপে সময়ের স্থায়িত্ব প্রত্যেকের ক্ষেত্রে হয় ভিন্ন।

যে গভীর দুঃখ অনুভব হয় তার প্রকাশও হয় ভিন্নভাবে। শোকাহত মানুষকে প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বুঝতে হবে এবং বিবেচনা করতে হবে। তিনি কখন কোন ধাপে আছেন এবং প্রতি ধাপই ভিন্ন। ধাপভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা  নেওয়াটাই বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসার অংশ। শোকের ৫টি ধাপ নিম্নরূপ-

অস্বীকার ও একাকিত্ব রাগ, অনুরাগ, প্রতিরাগ মানসিক দণ্ড ও নিয়ন্ত্রণহীনতা ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা হতাশা, নিরাশা
বাস্তবতা মেনে নেওয়া এবং এগিয়ে যাওয়া

বিয়োগশোক, তীব্র শোক ও শোক পালন

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যে মায়েরা বা নিকটাত্মীয়রা ছাত্রজনতার গণঅভ্যুথানে তাদের প্রাণ প্রিয় সন্তান, ভাই-বোন বা স্বজন হারিয়েছে তারা শোকের সাগরে ভাসছে তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধারে প্রয়োজন গ্রিফ এডুকেশন/ শোক শিক্ষা ও গ্রিফ থেরাপি। তাদেরকে এহেন সাইকোসোশ্যাল থেরাপি বা সাপোর্ট দেয়া সমাজের বিবেকবান প্রতিটি সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ভলানটিয়ার বা স্কাউটরাই পারে তাদেরকে সামাজিক সহায়তার সাথে সাথে মানসিক/ সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ে সম্পৃক্ত করতে। তবে এক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকোলজিস্টদেরকে অবশ্যই উপরোক্ত ধাপ অনুসারে প্রয়োজনীয় করণীয় বা না-করণীয় সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। শোকের ব্যবস্থাপনা: শোকপালন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটি তখনই অস্বাভাবিক হয়, যখন এটি দীর্ঘায়িত এবং তীব্রতর/ মারাত্মক হয়। তখন একে জটিল বা অস্বাভাবিক শোক বলে। যারা সাধারণ শোকগ্রস্ত হয় তার মাত্র ৭% জটিল শোকে ভুগে (সিমন, ২০১৩)।

অস্বাভাবিক শোকের কারণ:

  • হঠাৎ মৃত্যু।
  • অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।
  • অতি কাছের বা নির্ভরযোগ্য সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যু।
  • অনিরাপদ ও মানসিক রোগের পূর্ব ইতিহাস।
  • বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি যার নির্ভরশীল সন্তান রয়েছে।

তীব্র শোক ও বিষণ্ণতার পার্থক্য:

তীব্র শোক-

১। এটি বারংবার ঢেউ এর ন্যায় আসে

২। সময়ের সাথে তীব্রতা কমে

৩। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর

৪। মৃদু হতাশা কাজ করে

৫। সহযোগিতায় উন্নতি হয়

৬। রাগের অতি প্রকাশ ঘটে

৭। মৃত ব্যক্তির স্মৃতিতে শোকাচ্ছন্ন থাকে

৮। সাধারণত মৃত্যুর ০২ মাসের মধ্যে শুরু হয়

৯। স্বল্পমেয়াদি

১০। নিজস্ব ও পারিবারিক অতীত ইতিহাস থাকে না

বিষণ্ণতা-

১। এটি সাধারণত স্থির

২।  সার্বক্ষণিক নিচু মনোভাব থাকে

৩। নিজেকে অকর্মণ্য বা অপদার্থ ভাবে

৪। ব্যাপক হতাশা কাজ করে

৫। সাধারণত সাহায্য কাজ হয়না (ঔষুধ প্রয়োজন হয়)

৬। রাগের প্রকাশ কম তবে হতাশা ও নিরাশার অতি প্রকাশ ঘটে।

৭। নিজেকে নিয়ে আচ্ছন্ন থাকে

৮। যেকোনো সময় শুরু হতে পারে

৯। দীর্ঘমেয়াদি

১০। সাধারণত নিজস্ব ও পারিবারিক অতীত ইতিহাস থাকে

চিকিৎসা-

১। সকলে সাহায্য ও সহযোগিতা করা (পরিবার, বন্ধু, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গুরু, পারিবারিক চিকিৎসক ইত্যাদি)।
২। পরিকল্পিত উপদেশ বা কাউন্সেলিং, যেমন-

  • মৃতব্যক্তির ভালো দিক নিয়ে কথা বলা।
  • আবেগীয় অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা।
  • শোকের স্বাভাবিক পথ বুঝা বা জানা।
  • বাস্তব ক্ষতি মেনে নেয়ার পরামর্শ।
  • শোকের ধাপ সমূহ নিয়ে কর্ম পর্যালোচনা।
  • মৃত ব্যক্তিকে ছাড়া জীবন চলা বা সমন্বয় করা।
  • সর্বোপরি কঠিন বাস্তবতাকে গ্রহণ করা/মেনে নেয়া।

৩। ড্রাগ চিকিৎসা বা ঔষধ: বিশেষ পরিস্থিতিতে ধাপ বা পর্যায় অনুযায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ চিকিৎসা দিবেন।

১ম ধাপ:

  • ঘুমের ঔষধ বা হিপনটিকস।
  • অতি উদ্বেগের জন্য উদ্বেগবিনাশী বা এনজিওলাইটিকস।

২য় ধাপ:

  • বিষণ্ণতার জন্য বিষণ্ণতা বিরোধী বা এন্টি ডিপ্রেসেন্ট।
  • প্রয়োজনে গঠনতান্ত্রিক বা স্ট্রাকচারড সাইকোথেরাপি অথবা
  • সম্মন্বিত/কম্বাইন্ড থেরাপি যেমন-সিজিটি (কপ্লিকেটেড গ্রিফ থেরাপি), সিবিটি (কগনিসেভ বিহেভিয়ার থেরাপি ইত্যাদি।

৪। নন ড্রাগ চিকিৎসা: কাউন্সেলিং অথবা সাইকোথেরাপি (প্রয়োজনে)।

৫। পুনঃআশ্বস্তকরণ বা রিএসিউরেন্স ও সহযোগী গ্রুপ বা সাপোর্ট গ্রুপ যেমন- ক্রজ/ক্রেজ গ্রুপ (ইন ইউকে)।

(লেখাটি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে শহীদদের এবং তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও নিকট আত্মীয়দের প্রতি উৎসর্গ করা হলো)

আরও পড়ুন-

Previous articleবিএপি’র দক্ষিণ (খুলনা ও বরিশাল বিভাগে) নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন
Next articleবিএপি’র চট্টগ্রাম বিভাগে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here