বদলে যাওয়া বিশ্বে তরুণদের যৌনচিন্তা

অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যৌনরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত

কয়েকদিন ধরে যে ঘটনাটি সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকে ঝড় তুলেছিল তা হলো-একজন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক টিনএজ ছেলেমেয়েদের আটক হওয়া। ভিডিওতে দেখা গেল অনেকগুলো ছেলেমেয়ে আটক হয়ে বসে আছে। তাদের অপরাধ তারা পার্কে ডেটিং করতে এসেছিল। শুধু পার্কে নয় নগরীর খাবারের দোকান থেকেও তাদেরকে ধরা হচ্ছিল। ফেসবুকে এর পক্ষে-বিপক্ষে উভয় রকমের কমেন্ট আসছিল। কারো মতে কাজটা একদমই ঠিক হয়নি। এভাবে অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায় না। আবার আরেক দলের বক্তব্য হল কিছু না বলে তরুণ সমাজকে এভাবে উচ্ছন্নে যেতে দেওয়া যায় না।

উভয়পক্ষের কথায়ই যুক্তি আছে। কোনো বিশেষপক্ষকে সমর্থন করতে এই লেখা নয়। তবে যে কথাটি বলার জন্য ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওগুলোর প্রসঙ্গ তোলা তা হলো পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ছেলেমেয়ে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। রুমডেট, পুল পার্টির মতো কিছু শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হচ্ছে। রিহ্যাব শব্দটিও এখন আর আগের মতো নতুন লাগে না। পাড়া-মহল্লার অনেক বাড়িতেই গড়ে উঠেছে রিহ্যাব সেন্টার নামের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। ঠিক কতজন ইয়াবাতে আসক্ত তার সঠিক হিসেব না দিতে পারলেও বর্তমানে কোনো রিহ্যাব সেন্টারই রোগীর অভাবে ধুকছে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফ্লোর বাড়াতে হচ্ছে তাদের। উত্তরা, ধানমন্ডি, রামপুরার বনশ্রীর মতো অভিজাত এলাকাগুলোতে তৈরি হয়েছে ছোটদের গ্যাং। ছোট বলতে এরা স্কুল গোয়িং। অথচ এই বয়সেই এরা খুন- খারাবিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

ওপরের যে তিনটি চিত্রের কথা বললাম তা আমাদের এই সমাজেরই বর্তমান অবস্থা। আমরা সবাই কম- বেশি এই অবস্থার সাথে পরিচিত। পত্রিকা খুললেই এ ধরনের নিউজ আমাদের চোখে পড়ে। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের বয়সের কোঠা বারো থেকে চল্লিশের মধ্যে। অর্থাৎ তারা কিশোর থেকে যুবক। এক কথায় তারা আমাদের তরুণ সমাজ যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। সেই তরুণ সমাজের মধ্যেই আগের তুলনায় এ ধরনের সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গিতে সৃষ্ট এই সামাজিক সমস্যাগুলোর পেছনে জড়িত মানসিক রোগটিই চোখে পড়ে। কোমলমতি স্কুল গোয়িং কিশোরদের এই যে বখে যাওয়া সেটাকে মেডিক্যালের ভাষায় বলা হয় কনডাক্ট ডিজঅর্ডার।

এর চিকিৎসা আছে। মাদকাসক্তি যে মানসিক রোগ সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক সেটা কোনো রোগ নয়। তবে যে বয়সে হচ্ছে সেটা তার প্রস্তুতির সময়। সুস্থ টেকসই পারস্পারিক নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতি লাগে। আর তাই কৈশোর এবং যৌবনের শুরুর দিকটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে- যত ধরনের মানসিক রোগ আছে তার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মানসিক রোগ ১৪ বছর বয়স থেকে শুরু হয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা হয় না। কৈশোর জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য শীর্ষস্থানীয় যে তিনটি রোগ দায়ী তার মধ্য বিষণ্ণতা তৃতীয়। দ্বিতীয়টি হলো আত্মহত্যা। আত্মহত্যা ১৫ থেকে ২৯ বছরের বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ। সে কারণেই এ বছরের ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’-এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘পরিবর্তিত পৃথিবীতে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য’।

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো যদি মানসিক রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা যায় তবে সেটা অনেক বেশি সাশ্রয়ী। কম লোকবল এবং কম বাজেটে অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতিরোধের ভালো উপায় হলো এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। মানসিক রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা রেজিলিয়েন্স জাগিয়ে তোলা। পৃথিবী বদলে যাচ্ছে তারচেয়েও বড় কথা হলো অনেকটাই বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে তরুণদের। তারুণ্যটা কৈশোর থেকে শুরু করে মধ্য বয়সের আগ পর্যন্ত। এই সময়টায় মানুষের জীবন অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। তার একাডেমিক পরিবেশ বদলে যায়। তার ব্যক্তিগত জীবনে অধিকারবোধ পাল্টাতে থাকে। শরীরে হরমোনের লেভেলে বদলাতে থাকে। যৌন জীবনের সূচনাকালও এটি। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক বদলাতে থাকে। এই সময়েই সে পরিবারের বাইরে পা রাখে। পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই এই বয়সে তার মানসিক স্বাস্থ্যের যথাযথ যত্ন নিতে পারলে অনেক মানসিক রোগকে শুরুতেই ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যৌনস্বাস্থ্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে-যৌন সমস্যায় ভোগা রোগীদের একটা বড় অংশ যৌন বিষয়ে অজ্ঞতাজনিত কারণে যৌনরোগে ভুগছেন। যৌনশিক্ষার মাধ্যমে যা খুব সহজেই দূর করা যায়। কিন্তু সমস্যটা অন্য জায়গায়; যৌন শিক্ষার জন্য দেশে কোনো বিশেষ গাইডলাইন না থাকাতে যে যার মতো নেট দেখে শিখছে। যার অনেকগুলোই ভ্রান্ত। সেগুলো দেখে তাদের বিভ্রান্তি আরো বাড়ছে সেইসঙ্গে বাড়ছে অ্যাংজাইটি। পর্নোগ্রাফি এখন অনেক সহজলভ্য হয়ে
গেছে। মোবাইলে ক্লিক করা মাত্রই হাজির হচ্ছে স্ক্রিনে। সেটা প্রভাব ফেলছে আমাদের যৌন আচরণে।

আমাদের যৌন চাহিদার মধ্যে পর্নোগ্রাফির প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অবাস্তব অনেক চাওয়া পূর্ণ করতে যেয়ে আমরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। মুঠোফোনের মাধ্যমে খুব সহজেই আপনি ঢুকে পড়তে পারছেন অন্যের বেডরুমে। আগের ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে আবার চাঙ্গা করে তোলাও কঠিন কিছু নয়। নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটাও সহজ। সে ক্ষেত্রে সোস্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা রাখছে। টিনএজারদের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ারও কারণ এই সোস্যাল মিডিয়া। আগে যেখানে চিরকুট বা চিঠি দিয়ে সম্পর্ক করতে হতো এখন সেখানে লাইক, কমেন্ট ইমো দিয়েই খবু সহজে কাছে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়াতে একটির পরিবর্তে কয়েকটি সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে।

যৌন শিক্ষার মতো সম্পর্ক শিক্ষাও আছে যাকে বলে রিলেশনশিপ ডায়নামিকস। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সে বিষয়ে পরামর্শ ও পুস্তিকা সরবরাহ করা হয়। ফলে তারা বুঝেশুনে সম্পর্কে যেতে পারে। সম্পর্কজনিত মানসিক জটিলতা তাতে কম হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার মানসিক বিশেষজ্ঞদের প্রাইভেট চেম্বারে দেখা রোগীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ রোগী সম্পর্কজনিত জটিলতার কারণে মানসিক বিশেষজ্ঞ দেখান। সম্পর্কে জটিলতার কারণে যেমন বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে। তেমনি সেক্সয়্যাল ডিজফাংশন, বিভিন্ন ধরনের অ্যাংজাইটিও দেখা দিতে পারে। আত্মহত্যার মতো সাইকিয়াট্রিক ইমারজেন্সি, সেল্ফ ইনজুররিয়াস বিহেভিয়ার (নিজেকে আঘাত করা) অথবা হোমিসাইড (খুন) এর মতো ঘটনাও ঘটে।

যৌনতা ও সম্পর্কগত বিষয়ে তরুণ সমাজকে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে এই সংক্রান্ত মানসিক রোগগুলো প্রতিরোধ করা যায়। আসুন আমরা যৌন ও সম্পর্কের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হই এবং একে অপরকে সচেতন করে তুলি।

আমাদের যা করণীয়-

  • যৌন বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র বা রিসোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ।
  • যৌন বিষয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস বা কুসংস্কারকে চিহ্নিত করা এবং সেসবের বিপরীতে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাগুলো জেনে নেওয়া।
  • সম্পর্কের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র বা রিসোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ।
  • সম্পর্কের বিষয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস বা কুসংস্কারকে চিহ্নিত করা এবং সেসবের বিপরীতে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাগুলো জেনে নেওয়া।
  • নিজেকে যৌন বা সম্পর্কের ভিক্টিম হতে না দেওয়া।

এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখলে অনাকাঙ্খিত মানসিক সংকট বা জীবনের আকস্মিক অনেক বিপর্যয়কে সহজেই এড়ানো সম্ভব।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে পূর্ব প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleউপহার মন ভালো করে
Next articleঘুমন্ত অবস্থায় গালি দিই
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here