প্রিয়জনের আকস্মিক মৃত্যুর পর কখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে?

0
0
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাব উদ্দিন মুজতবার মৃত্যু

ডা. মো. মেহেদী হাসান

মেডিকেল অফিসার, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা

ঘটনা ১: স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল ‘মিসেস শামীমার’ । স্বামী এবং দুইটি ফুটফুটে সন্তানকে নিয়ে সাজানো সংসারটা হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও আস্তে আস্তে তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলেন। সন্তান দুটিকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

ঘটনা ২:  মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে  ‘ ফারজানা ‘ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ল। সব কাজকর্মের জন্য সে মায়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। মায়ের শোক সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বই নিয়ে পড়তে বসলেও এখন মায়ের মুখ খানা ভেসে ওঠে। মায়ের  পছন্দের খাবার গুলো এখন মুখেও তুলতে পারে না। প্রতিনিয়ত তার মনে হতে লাগলো মাকে ছেড়ে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়াটাই ভালো। তার প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হতে লাগলো। ফারজানা কে দেখে এখন চেনাই যায় না। মনে হয় মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে ফারজানার ও যেন আত্মার মৃত্যু ঘটেছে।

উপরের দুটি ঘটনার নেপথ্যের কারণ একই হলেও দুজন মানুষ ভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রিয়জনের মৃত্যু কারোরই কাম্য নয় কিন্তু তারপরেও আমাদের সবাইকেই এই কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এই কষ্ট  যদি সীমা অতিক্রম করে ফেলে সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া অতীব জরুরী।

Magazine site ads

প্রত্যেকটি মানুষকে ঘিরে তার কাছের মানুষদের একটা নিজস্ব জগত থাকে।  সেই মানুষটি মৃত্যুবরণ করলে  তাকে ঘিরে থাকা জগতটি উলটপালট হয়ে যায়।

প্রিয়জনের মৃত্যুর পর কষ্ট পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে সেই কষ্ট পাওয়াটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে রূপ নেয়।

‘এলিজাবেথ কুবলার রজ ‘ এর মতে প্রিয়জন হারানোর পর আমরা নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাই। সেগুলো হলঃ

১.  তীব্র ধাক্কা: শুরুতেই  আমরা প্রচন্ড শক এ চলে যাই এবং  এটা মানতে পরিনা। ( মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) মারা যাওয়ার পরে ওমর (রা:) আচরণ মনে আছে?)

২. রাগ: প্রচন্ড রাগ হয়। (যেমন: কেন আমার সাথেই এমন হলো…) অসহ্য কষ্ট লাগে। হতাশ লাগে…

৩. দরকষাকষি:

(যেমন: আল্লাহ ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও, আমি আর কখনো ওর সাথে রাগ করবো না…)

৪.. বিষন্নতা:  অনুভূতিগুলো অসাড় হয়ে আসে। বিভিন্ন রকমের চিন্তা মাথায় আসে. ( যেমন:আমি দিব্যি বেঁচে আছি অথচ আমার প্রিয় মানুষটা এখন কবরে শুয়ে আছে…, আমিও যদি ওর সাথে মারা যেতাম ভালো হতো…,) আত্মহত্যার চিন্তা আসে

৫. মেনে নেয়া: আমরা যাকে হারিয়েছি তাকে আর ফিরে  পাওয়া সম্ভব না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।( যেমন: আমার ভালবাসার মানুষ আমি হারিয়েছি, এর চেয়ে কষ্ট করার কিছু হতে পারে না, তাও আমি চেষ্টা করব নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে..)মনের খবর ম্যগাজিনে

এই প্রতিক্রিয়া যদি ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকে তাহলে সেটা অস্বাভাবিক বলে মনে করতে হবে। প্রায় ৭ % মানুষই প্রিয়জন হারানর পর এ সমস্যার মুখোমুখি হন।

কখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিব:

  • তীব্র বেদনায় ভারাক্রান্ত হলে
  • বিচ্ছেদ-বেদনা দীর্ঘমেয়াদি হলে
  • বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হলে
  • খুব বেশি রাগ হলে
  • প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে না পারলে
  • ঘুমের সমস্যা হলে
  • কষ্ট কমানোর জন্য নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করলে
  • ব্যক্তিগত ,পারিবারিক, সামাজিক, ও কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হলে।
  • প্রিয়জনের স্মৃতিযুক্ত সবকিছু এড়িয়ে চললে
  • প্রিয়জনের মৃত্যুর প্রথম ১৪ দিনের মধ্যেও কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া না হলে
  • ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে শোক বিরাজমান থাকলে

কথায় বলে, ” অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর!”

এটি অনেক ক্ষেত্রে সত্য হলেও শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে জীবনের চলায়  প্রাথমিক ভাবে হোঁচট খেলেও তার স্মৃতিকে আগলে ধরেই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি। তাদের স্বপ্ন পূরণ করার তীব্র ইচ্ছা আমাদের পাথেয় হয়ে ওঠে।

কবি আল মাহমুদ এর ভাষায়…

” কোন এক ভোর বেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাগিদ;

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালো-মন্দ যা ঘটুক মেনে নেব এ আমার ঈদ।”

আরও পড়ুন-

Previous articleসব কিছু নিয়ে আমি সারাদিন খুব হতাশ থাকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here