এক সময় সমাজে প্রচলিত ধারণা ছিলো, নারীর কারণে গর্ভে সন্তান আসে না। যদিও বহু ক্ষেত্রেই গর্ভে সন্তান না আসার পেছনে পুরুষের কারণই বড়।
নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই আগে এমন কোনো লক্ষণ থাকে না, যা দেখে অনুমান করা যায় সে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নয়। তাই বিষয়টি সাধারণত প্রথম ধরা পড়ে দাম্পত্য জীবনে, যখন তারা সন্তান লাভের চেষ্টা করে।
সাধারণভাবে ধারণা হলো, পুরুষ যদি দৈহিকভাবে মেলামেশায় সক্ষম হয়, তার যদি বীর্যপাত হয়, তাহলে সে সন্তান জন্মদানে সক্ষম। যদিও বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়। দৈহিক সক্ষমতা বা বীর্য উৎপাদন, স্ত্রীর প্রতি আসক্তি ইত্যাদি সন্তান জন্মদানের জন্য যথেষ্ট নয়। বীর্যে সঠিক গড়নের গুণগত মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত সংখ্যক শুক্রাণুর উপস্থিতি থাকতে হবে।
পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ
শুক্রাণু উৎপাদন ও পরিবহন সমস্যাই মূলত পুরুষ বন্ধ্যত্বের কারণ। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক কারণটি নির্ণয় করা যায়। দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে টেসটিস বা শুক্রাশয় থেকে সঠিক সংখ্যক শুক্রাণু তৈরি হয় না অথবা শুক্রাণুর গুণগত মান ঠিক থাকে না।
অন্যদের শুক্রবাহী নালি অথবা পুরুষাঙ্গের গঠনগত সমস্যার কারণে শুক্রাণু বীর্য রসে পৌঁছাতে পারে না। অর্থাৎ শুক্রাণু তৈরি হওয়ার পর থেকে গতিপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে। বীর্য পরীক্ষার রিপোর্টে তখন শুক্রাণু পাওয়া যায় না।
পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। নিন্মে তা আলোচনা করা হলো।
শুক্রাণু তৈরি বা উৎপাদনে সমস্যা
জেনেটিক বা ডিএনএ ঘটিত কারণে অনেক সময় একজন পুরুষ শুক্রাণু উৎপাদনক্ষমতা হারাতে পারে বা জন্মগতভাবে তার এ ক্ষমতা না থাকতে পারে। যেমন- ওয়াই ক্রোমোজোম মাইক্রোডিলিশন, এক্সএক্সওয়াই ইত্যাদি।
অনেক সময় শুক্রাশয় বা টেসটিস অণ্ডকোষের ভেতরে না এসে দেহের অভ্যন্তরে কোথাও অবস্থান করে। এটিও এক ধরনের জন্মগত ত্রুটি। তখনও সে সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয় না। তাই ছেলে শিশুর জন্মের পরপরই দেখা উচিত অণ্ডকোষের ভেতরে দুটি টেসটিস আছে কি না।
যদি না থাকে তবে শরীরের ভেতর থেকে তা বের করে আনার অপারেশন আমাদের দেশেও সহজে করা যায়। পরবর্তী সময়ে সে সন্তানের জন্মও দিতে পারে। সবজি, ফল ও মাংসে ব্যবহৃত স্টেরয়েড শরীরে প্রবেশ করে পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
তাছাড়া টেসটিসে রক্ত চলাচলের শিরা-ধমনির সমস্যা বা ভেরিকোসিলি, মামস ইনফেকশনের কারণে টেসটিস ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে, খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে ভেজাল যেমন- ফরমালিন, সিসা, পারদ ইত্যাদি প্রবেশ করলেও শুক্রাণু উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
শুক্রাণু পরিবহনে সমস্যা
পুরুষের প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি হলে শুক্রাণু তৈরি হয় কিন্তু তা বীর্যরসে মিশতে পারে না। আবার শুক্রবাহী নালিতে ব্লক বা প্রতিবন্ধকতা থাকলে অথবা কখনো ভ্যাসেকটমি করা হলে শুক্রাণু পরিবহনে সমস্যা হতে পারে।
যৌন সমস্যা
সঠিক মাত্রায় পুরুষাঙ্গ উত্তেজিত না হওয়া বা ইরেকটাইল ডিজফাংশন, বীর্যপাত না হওয়া, স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মেলামেশায় অক্ষমতা, দীর্ঘ দিন বিরতি দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসেও পুরুষের বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
হরমোন সমস্যা
হরমোনের তারতম্যের জন্য বহু ক্ষেত্রে গুণগত মানের শুক্রাণু তৈরি হয় না। মনে রাখা দরকার, গুণগত মানের শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলোর মধ্যে আছে এফএসএইচ, টেস্টোস্টেরন, টিএসএইড, প্রলাকটিন। অনেকে যৌনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কিছু হরমোন গ্রহণ করে থাকে যা যৌনক্ষমতা বাড়ায় কিন্তু পুরুষের বন্ধ্যত্বও ঘটায়।
নেশাজাতীয় দ্রব্যৎ
ধূমপান, মদ্যপান, নিষিদ্ধ ড্রাগ পুরুষের শুধু শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত করে না পুরুষের শারীরিক অক্ষমতাও বাড়ায়, যা পুরুষের বন্ধ্যত্ব সমস্যার অন্যতম কারণ।
জীবনযাপনের রীতিনীতি
দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনেক স্বভাব-চরিত্র পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। যেমন- টাইট জিনস ও আন্ডারওয়্যার পরা, দীর্ঘক্ষণ মোটরসাইকেল চালানো, গরম পানিতে গোসল, তলপেটের ওপর বা কোলে নিয়ে ল্যাপটপ ব্যবহার, দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে বাসের সিটে বসে থাকা, অত্যধিক গরম পরিবেশে কাজ করা ইত্যাদি।
এসব কারণে শুক্রাশয়ের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে শুক্রাণু উৎপাদন কমে গুণগত মান নষ্ট হয়। আবার অত্যধিক ঠাণ্ডায়ও শুক্রাণু মরে যায়। অধিক ওজন, চর্বিযুক্ত খাবার পুরুষের বন্ধ্যত্ব সমস্যা বাড়ায়।
মোবাইল ফোন
মোবাইল ফোনের মাইক্রোওয়েভ পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে কথা বলা, প্যান্টের পকেটে মোবাইল রাখা, একের অধিক মোবাইল, শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ চালিত নেটওয়ার্ক পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা প্রদান করে।
পুরুষের বন্ধ্যত্ব নির্ণয় হয় যেভাবে
কোনো দম্পতি যদি টানা এক বছর নিয়মমতো দৈহিক সম্পর্ক বজায় রাখা সত্ত্বেও সন্তান লাভে ব্যর্থ হয়, তখন চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন।
খরচ কম ও সহজে করা যায় বলে সাধারণত প্রথমেই স্বামীকে বীর্য পরীক্ষার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। তিন থেকে পাঁচ দিন মেলামেশা বন্ধ রাখার পর নির্ধারিত ল্যাবে গিয়ে এই পরীক্ষা করতে হয়। বীর্য পরীক্ষার রিপোর্টে প্রতি মিলি বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা, শুক্রাণুর নড়াচড়ার গতি, গঠনগত তারতম্য ইত্যাদি দেখা হয়।
বীর্য পরীক্ষার রিপোর্টে সমস্যা থাকলেই কেবল কারণ অনুসন্ধানের জন্য স্বামীকে রক্তের সুগার, হরমোন ও টেসটিস বা শুক্রাশয়ের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি প্রাথমিক পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কারণ ধরা না পড়লেই কেবল বিরল কারণ অনুসন্ধানের পরীক্ষা দেওয়া হয়, যা কিছুটা ব্যয়বহুল।
চিকিৎসা
কারণ অনুযায়ী পুরুষ বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেমন- শারীরিক অক্ষমতা, শুক্রাণুর সমস্যাসহ পুরুষ বন্ধ্যত্বের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে। চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিক জীবনযাত্রা, নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার, ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি পুরুষের বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে বেশির ভাগ পুরুষের শুক্রাণুজনিত সমস্যা সমাধান করা যায়। যাদের শুক্রাণু সমস্যা চিকিৎসা করার পরও ঠিক হয়নি, তাদের জন্য টেস্টটিউব বেবি বিশেষত আইসিএসআই পদ্ধতি সর্বশেষ উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে মাধ্যমে টেসটিস হতে সরাসরি মাত্র কয়েকটি শুক্রাণু সংগ্রহ করেও সন্তান জন্মদান সম্ভব।
পুরুষের বন্ধ্যত্ব প্রতিরোধ
বাবা হতে চান এমন সব পুরুষের উচিত পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া। ধূমপান, মদ্যপান, নেশাজাতীয় দ্রব্য এড়িয়ে চলা। টাইট আঁটসাঁট পোশাক না পরা। অত্যধিক তাপমাত্রার পরিবেশ, এক্সরে, সিটি স্ক্যান হয় এমন জায়গায় চলাচল না করা।
শরীরের সঙ্গে অণ্ডকোষ দীর্ঘ সময় চেপে লেগে থাকে এমন অবস্থান পরিহার করা, তলপেটের ওপর ল্যাপটপের ব্যবহার না করা, হরমোন/স্টেরয়েডের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্য বর্জন করা। আবার শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখাও পুরুষের বন্ধ্যত্ব প্রতিরোধের জন্য জরুরি।
অধিক বয়সে পুরুষের বন্ধ্যত্ব
যেকোনো বয়সে পুরুষের বন্ধ্যত্ব সমস্যা হতে পারে। আবার অধিক বয়সের পুরুষও সন্তানের জন্ম দিতে পারে। তবে অধিক বয়সের পুরুষের স্ত্রীর গর্ভধারণ করতে বেশি সময় লাগতে পারে। কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের দৈহিক মেলামেশার হার ও শুক্রাণুর গুণগত মান কমতে পারে।
প্রয়োজনে কাউন্সেলিং
বেশির ভাগ পুরুষ মনে করে দৈহিকভাবে সক্ষম ও মেলামেশার সময় বীর্যপাত হলে সে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু বীর্য পরীক্ষার রিপোর্টে যখন সমস্যা ধরা পড়ে তখনই একজন পুরুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
তার আবেগ-অনুভূতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। তাই চিকিৎসা দেওয়ার সময় তার মানসিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে