ডা . মো . আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
বর্তমান বিশ্ব ও পরার্থপরতা
পৃথিবীতে প্রায় প্রতিদিনই ছোট—বড় অসংখ্য সংঘাত ও দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। কোনো একটি সমস্যা বা দুর্ঘটনা দেখা দিলে বিপদগ্রস্ত মানুষের উদ্ধারের পাশাপাশি তাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ পুনর্বাসনের প্রয়োজন দেখা দেয়। কোথাও কোনো দুর্ঘটনা বা সহিংসতা হলে সংকটাপন্ন মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওগুলো বিপন্ন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে, তবে তারা বিনিময়ে বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর নিকট থেকে অনুদান সংগ্রহ করে।
তবে সব কিছুর পাশাপাশি আমরা এটাও দেখি যে, অনেক মানুষ আছেন যারা শুধুমাত্র উপকার করার নেশায় নিজের জীবনের ঝুঁকি না ভেবে অন্যের বিপদে তাদের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে বাঁচবে কি মরবে, তা তার কাছে তখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে না। অন্যের বিপদে তার মন কাঁদে। অন্যের উপকারে না লাগতে পারলে তার মন খারাপ হয়। এখানে তার কোনো পার্থিব স্বার্থ বা চাওয়া থাকে না। নিজের স্বার্থ ও জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে অন্যের উপকারের জন্য কাজ করাকেই পরার্থপরতা বলে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পরার্থপরতার প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধির ফলে মানবিক আচরণের প্রতি কৌতূহল বাড়ছে এবং এটি মানুষের মধ্যে সংহতি বাড়িয়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

পরার্থপরতার ইতিহাস
পরার্থপরতাকে ইংরেজিতে altruism বলে যা ল্যাটিন “অল্টার” শব্দ থেকে এসেছে। এর আক্ষরিক অর্থ হল “অপর—বাদিতা”। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কমতে স্বার্থপরতার বিপরীতার্থক শব্দ হিসেবে পরার্থপরতা শব্দটি ব্যবহার করেন। অক্সফোর্ড অভিধান হতে জানা যায় ১৯৫৩ সালে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। কমতের মতে মানুষের জীবনে দুটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য থাকে— অহংকারবোধ ও পরার্থপরতা। বেশিরভাগ মানুষের মানবিক ব্যবহার নিজেকে ঘিরে হলেও অন্যদের সাহায্য করার নিঃস্বার্থ ইচ্ছাকে প্রশান্তি লাভের মাধ্যম রূপে দেখেছেন সমাজবিজ্ঞানী কষ্ট। পরবর্তীতে ফ্রেঞ্চ সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডারখিম অনুরূপ ধারণাগুলি আরও উন্নত করেন তার ‘দা ডিভিশান অফ লেবার ইন সোসাইটি’ তে। ১৮৯৩ সালের তার এই লেখায় তিনি বলেছিলেন, পরার্থপরতা এবং অহংকারবোধ মানুষের ইতিহাসে সব সময়ই ছিল, কারণ জাতি হিসাবে সমাজবদ্ধ বসবাস করার ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো সামাজিক জীবনের নেতিবাচক দিকগুলোর উপর মনোবিজ্ঞানের ঝোঁককে কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি মানুষের স্বভাবে অসুস্থতা এবং বিকারতার নিন্দা করে বলেছিলেন “সহৃদয়তা, উদারতা, দয়াশীলতা এবং দানশীলতা খুব সামান্যই স্থান পেয়েছে সামাজিক মনোবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে।”
সামাজিকভাবে সহানুভূতিশীল আচরণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে খুব সামান্য ধারনাই দেখতে পায় আমরা। পরার্থপরতা নিয়ে রাশিয়ান দেশান্তরী পিটিরিম সোরোকিন এর নিবন্ধগুলিতে অনেক ধারনা পাওয়া যায়। তিনি ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানের ভীত রচনা করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ মৃত্যু আর ধ্বংসলীলার পরে পরার্থপরতার প্রতি অনুগত হয়ে পড়েন। ১৯৪০ এর দশকের শেষে তিনি পরার্থপরতার উপর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হার্ভার্ড রিসার্চ সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ অল্ট্রুইস্ম স্থাপন করেন এবং ১৯৫০ সালে তাঁর অল্ট্রুইস্টিক লাভ বইয়ে বিশিষ্ট পরার্থবাদীদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করেন। পিটিরিম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাসলো ১৯৫৫ সালে রিসার্চ সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ অল্ট্রুইস্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মর্যাদা লাভ করেন। মাসলো তার চিকিৎসক ও শিক্ষক আলফ্রেড এডলারের সাথে এক হয়ে সহানুভুতি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মতো সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিষয়গুলোকে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমান করার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। দুর্ভাগ্য যে সোরোকিন ও মাসলোর
মৃত্যুর পর পরবর্তী বিশ বছর পরার্থপরতার মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে আবার দুটি বিষয় নিয়ে ১৯৮০ এর শেষ দিক হতে পরার্থপরতার উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। প্রথমটি ছিল মূলত কাহিনী ভিত্তিক, সাহসী হিরোদের জীবন নিয়ে গবেষণা অর্থাৎ যারা তাদের জীবন বাজি রেখে পরার্থপরতার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন, যেমন দ্বিতীয়় বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা নাৎসি বাহিনী থেকে ইহুদীদের রক্ষা করেছিলেন এবং মাওলানা ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী ও মাদার টেরেসার মতো বিখ্যাত পরার্থবাদী ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্র নিয়ে। মানুষের মধ্যে সাহায্য করার মনোভাব ও সহনশীল আচরণ দলগত ভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। আবার মানুষ তার নিজের অস্তিত্বকে বেশী ভালোবাসে। ফলে সে জীবন দিয়ে হলেও তার সন্তানদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন, কারণ সে বেঁচে থাকার তুলনায় তার জিনের প্রতিরূপ অনেকটা সময় ধরে তার সন্তানদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে।
পরার্থপরতার নিদর্শন
আমাদের চারপাশে অনেকের মধ্যে প্রতিনিয়ত পরার্থপরতার নিদর্শন দেখতে পাই। অল্প কিছুদিন আগে সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে যখন অসংখ্য মানুষ ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে, তখন সরকারী ভাবে উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি অনেকেই নিঃস্বার্থভাবে জীবনের মায়া ত্যাগ করে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। কেউ কেউ উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে মারাও গিয়েছিল। সম্প্রতি ফেনী, নোয়াখালী, হবিগঞ্জের বন্যায় দেশের বিভিন্ন অংশ হতে লোকজন ছুটে এসেছিল পানিবন্দী মানুষের পাশে। জীবনের ঝুকি নিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেছেন, খাবার দিয়েছেন, বস্ত্র দিয়েছেন এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এক্ষেত্রেও কয়েকজন উদ্ধারকর্মীর পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি। যারা মারা গেলেন বা উদ্ধারে অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই বিপন্ন মানুষের নিকটজন বা আত্মীয় সম্পর্কের কেউ ছিলেন না। তারা কোন পারিশ্রামিকের জন্যেও কাজ করতে যাননি। উদ্ধার করতে গিয়ে তারা নিজেরাও যে বিপদে পড়তে পারেন, তা কি তারা জানত না? হ্যাঁ তারা সব জানত এবং সব জেনেই তারা দুর—দুরান্ত থেকে এগিয়ে এসেছিল তাদের পাশে দাড়াতে। এখানে কোন লোভ ও জীবনের মায়া তাদেরকে অপরের সাহায্য করার যে আকাংখা তা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র অন্যের উপকারের জন্য এধরনের কাজ করাই পরার্থপরতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার ধরুন একজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে অচেতন অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। সেখানে তার নিকটজন কেউ নাই। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে পকেটের পয়সা খরচ করে তার চিকিৎসা করালেন ও তার জীবন বাঁচালেন। অনেক গরীব মানুষকে রাস্তায় কোটি টাকার ব্যাগ পেয়ে তার মালিক খুজে তাকে ফিরিয়ে দিতে দেখি। অথচ সে টাকাগুলো রেখে দিলেও কেউ হয়ত জানতে পারত না। আবার ধরুন মাটি ধ্বসে কয়লার খনিতে অনেক শ্রমিক আটকা পড়েছে এবং সুরুঙ্গ করে তাদের উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু সবাই সুরুঙ্গ দিয়ে ভিতরে নামতে ভয় পাচ্ছে কিন্তু একজন নিজের বিপদ হতে পারে জেনেও ভিতরে নামল এবং একে একে সবাইকে বের করে আনল। আবার কোথাও আগুন লেগে লোকজন ঘরের মধ্যে আটকা পড়ার পর অনেককে জীবনের ঝুকি নিয়ে তাদেরকে বের করে আনতে দেখেছি। এসব কাজের জন্য তারা কোন বিনিময় মুল্য চায় না। হয়ত পরলৌকিক কোন চাওয়া থাকতে পারে কিন্তু বাস্তব জীবনে তারা কিছুই চায় না। অন্যের সুখের মাঝেই তারা নিজের সুখ খুজে পান। এরকম হাজারো পরার্থপরতার গল্প আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা।

পরার্থপরতার উপকারিতা
পরার্থপরতার অনুভব ব্যক্তির মনোভাবের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ব্যক্তি মনে—প্রানে প্রশান্তি লাভ করে। পরার্থপরতার চর্চা মানুষের সাথে মানুষের সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে। সমাজে অনাচারের পরিবর্তে শান্তি শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবার সমাজ তথা দেশের কল্যাণে আমাদের শিশু কিশোরদের মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা খুবই জরুরী। বড়রা যদি বেশী করে কল্যাণকর কর্মের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, অপরের প্রতি দয়াশীল আচরণ করে, তা ছোটদের মনের উপর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং তারাও বেশী মানবিক কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। পরের উপকারের মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, মনে প্রশান্তি আসে ও আধ্যাত্মিক সুখ লাভ হয়। সৃষ্টির সেবার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায়। একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে এবং সেই পৃথিবীর কাণ্ডারি হিসেবে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে তরুন প্রজম্মের মাঝে পরার্থপরতার চর্চা বাড়াতে হবে। ।
(সুত্রঃ ইন্টারনেট, বই ও বাস্তবতা)
আরও দেখুন-