একটি চুরির গল্প এবং কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব

শাহিদা ২৫ বছর বয়সী একটা মেয়ে একপ্রকার জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। একই শহরের একজন বিজ্ঞানী জনাব বিধান এমন একটা ঔষধ আবিষ্কার করলেন যেটা শাহিদার জীবন বাঁচাতে পারে। কিন্তু তিনি ঐ ঔষধের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা দাবি করছেন যদিও তার ঐ ড্রাগটা আবিষ্কার করার জন্য মাত্র ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ঐ অসুস্থ মেয়েটির স্বামী কাজল একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তিনি তার যতটুকু সম্পত্তি ছিল সব বিক্রি করে ও আত্বীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে সর্বসাকুল্যে ৩০ লক্ষ টাকা যোগাড় করলেন এবং ঔষধের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী জনাব বিধান কে বললেন যে আমার স্ত্রী মৃত্যুশয্যায় এবং আমি আমার সব সামর্থ দিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা যোগাড় করতে পেরেছি, আপনি আমাকে হয় বাকিতে ঔষধটা দেন অথবা আমি পরে আপনার সকল টাকা শোধ করে দেব, আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে ঔষধটা দেন। কিন্তু বিজ্ঞানী বিধান সাহেব এক টাকা বাকি থাকতে ঔষধটা দেবেননা বলে জানিয়ে দিলেন। রাগে, দুঃখে, মানসিক চাপে কাজল সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়লেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি বিধান সাহেবের ঔষুধের স্টোর থেকে ঔষুধটি চুরি করবেন এবং করলেন ও তাই! কাজল সাহেবের কি এই কাজটা করা উচিত হয়েছে? কেন?

কোহলবার্গের গবেষনায় তিনি এমন কিছু গল্প বলে শোনাতেন। গল্পগুলোতে নৈতিক দ্বন্দ্ব উপস্থিত থাকতো। প্রত্যেক গল্প শোনার পর তাদের কিছু প্রশ্ন করা হতো। প্রশ্নগুলোর উত্তর থেকে দেখা যেত যে তারা সমাজের নিয়ম কানুনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে নাকি ব্যক্তির নিজস্ব চাহিদাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। পরীক্ষণপাত্র অর্থাৎ যাদেরকে নিয়ে গবেষণা করতেন, তাদের যে গল্প বা কাল্পনিক কাহিনিগুলো শোনানো হতো সেগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যা ও ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হতো। কোহলবার্গের গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিগন ঘটনাটিকে ভুল বা সঠিক বললেন কিনা সেদিকে কোন আগ্রহ ছিল না, তিনি তাদের ভুল বা সঠিক বলার পেছনে কি যুক্তি প্রদর্শন করছে সেদিকে তিনি উৎসাহী ছিলেন।

মানব বিকাশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল নৈতিকতা। নৈতিকতা বিকাশ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুরা সমাজের অন্যান্য মানুষের প্রতি যথার্থ মনোভাব গড়ে তোলে, যে মনোভাব ও আচরণগুলো সমাজ, সংস্কৃতি, নিয়ম-কানুন ও আচার অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। নৈতিকতার বিকাশ একটি জটিল প্রক্রিয়া। নৈতিকতার বিকাশ নিয়ে আদিম সমাজ থেকেই মানুষের মধ্যে আগ্রহ থাকলেও ১৯৫০ সালের পূর্বে এটা নিয়ে তেমন কোন গবেষণা করা হয়নি।

নৈতিকতার বিকাশের ব্যাপারে সকল পিতা মাতা বেশ সচেতন থাকেন। শিশুদের কোনটি সঠিক, কোনটি ভুল তা শেখানো এবং তদানুযায়ী আচরণ করতে শেখানো প্রত্যেকটি পিতা মাতার মৌলিক প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে প্রধান। শিশুকাল থেকেই পিতা মাতা শিশুদের মধ্যে নৈতিকতার বিকাশ ঘটানোর জন্য চেষ্টা করেন। মানুষের ভিতর নৈতিকতার বিকাশ কিভাবে হয়, কখন হয় ও তা কিভাবে পরিবর্তিত হয় সেসব নিয়ে দার্শনিক, বিকাশ মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেছেন।

নৈতিকতা বিকাশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তত্ত্বটি প্রদান করেছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী লরেন্স কোহলবার্গ ১৯৬৯ সালে। নৈতিকতা বিকাশের সাথে তিনি জ্ঞানীয় বিকাশের যোগসুত্রের কথা স্বীকার করেছেন। কোহলবার্গের মতে, নৈতিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে মানুষ সুনির্দিষ্ট কিছু পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।

উপরের গল্পটি আবার মনে করুন, বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়কে মিলিয়ে নিন-
নৈতিকতা-টেবিল-২

কোহলবার্গ তার গবেষণায় দেখেছিলেন যে, শিশুদের ৭ বছর বয়েসে নৈতিকতার বিকাশ শুরু হয় এবং প্রথম স্তরকে বলা হয় Preconventional Level এবং এসময় শিশুরা কাজের ফলাফল দ্বারা তাদের কাজকে মূল্যায়ন করে। নৈতিকতা বিকাশের প্রথম পর্যায়ে শিশুরা শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিয়ম-কানুন মেনে চলে। যেমন, শিশুরা মনে করে চুরি করা খারাপ কাজ কারণ চুরি করলে শাস্তি পাবো। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে শিশুরা কিছুটা স্বার্থপর হয়ে ওঠে এবং সমাজের শাস্তির ভয়কে উপেক্ষা করে নিজেদের আনন্দের চাহিদার উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে। এই পর্যায়ে শিশুরা বিশ্বাস করে যে কোন কাজ নৈতিক হবে যদি তা ব্যক্তির কাছে আনন্দদায়ক হয়।

কোহলবার্গ লক্ষ্য করেন যে ১৩ বছর বয়েসের দিকে যখন সন্তান কৈশোরে পর্দাপণ করে তখন তারা নৈতিকতা বিকাশের দ্বিতীয় স্তরে পৌছে যায়। এসময় তাদের জ্ঞানীয় বিকাশ অনেকটাই সম্পূর্ণ হয়ে যায় তাই তারা তাদের চারপাশের পৃথিবীকে আরো যুক্তিপূর্ণ ও যথার্থভাবে মূল্যায়ণ করতে পারে। তৃতীয় পযায়ে এসে শিশুরা নিজেদের কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় কতৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এটাকে কোহলবার্গ বলেছেন Good boy/Good girl orientation। চতুর্থ পর্যায়ে সমাজের গুরুজনদের বা কতৃপক্ষের সমালোচনার ভয়ে সমাজের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন মেনে চলে। এসময় তারা প্রায়ই দায়িত্ব-কর্তব্য, সামাজিক আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে এবং মেনে চলার উপর গুরুত্ব দেয়।

কোহলবার্গের নৈতিকতা বিকাশের তৃতীয় স্তরের সাথে জিন পিঁয়াজের জ্ঞানীয় বিকাশের সর্বশেষ স্তরের ঘনিষ্ট সম্পর্ক পাওয়া যায়। যারা নৈতিকতা বিকাশের এই সর্বশেষ স্তরে পৌঁছাতে পারে তারা কিছু উচ্চ ও জটিল নৈতিক আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। এসময়কার নৈতিক আচরণগুলো কৃষ্টি বা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আরো বিস্তৃত আকার ধারণ করে।

কোহলবার্গের মতে সবাই নৈতিকতা বিকাশের এই সর্বশেষ ধাপে পৌঁছাতে পারেনা। পঞ্চম পর্যায়ে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন বা যুক্তি মেনে চলে। এসময় সমাজের অনেক নিয়ম-কানুন তার কাছে যুক্তিহীন, স্বৈরাচারি ও খামখেয়ালী মনে হয় কিন্তু তারা সমাজের উপকারের জন্য সেগুলোও মেনে চলতে সচেষ্ট থাকেন। ষষ্ঠ বা সর্বশেষ পর্যায়ে সমাজের নিয়ম-কানুন থেকে ব্যাপকভাবে সরে এসে তার নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি, নীতিবোধ ও বিবেক দ্বারা নিজেদের পরিচালিত করেন।

monon-600

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা। অনেকে বলেন পিঁয়াজের মতো কোহলবার্গও নৈতিক বিকাশকে জ্ঞানীয় দিক থেকে বিবেচনা করেছেন। কোহলবার্গের তত্ত্বের সমচেয়ে বড় সমালোচনা হল নৈতিক বিশ্বাস ও নৈতিক আচরণের মধ্যে সম্পর্ক। সমালোচকগণ বলেছেন যে কোহলবার্গ তার গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে মূলত তাদের নৈতিক বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে পারতেন কিন্তু গবেষণায় অংশগ্রহণকারিরা বাস্তব পরিবেশে ঐরকম আচরণ করতো কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কোহলবার্গ এই সমালোচনার উত্তর দিতে গিয়ে বলেন মানুষের নৈতিক বিশ্বাস তাদের নৈতিক আচরণকে অনুমাণ করতে পারে অর্থাৎ নৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী নৈতিক আচরণ হয়ে থাকে।

আবার অনেক সমালোচকগণ বলেছেন, তার মতবাদের কিছু পর্যায়ের সাধারণীকরণ করা সম্ভব নয়, সেগুলো শুধু উচ্চশিক্ষিত শিল্পোন্নত কিছু সমাজের সাথে মেলে। কোহলবার্গের সহকর্মী ক্যারোল গিলিগ্যান বলেছেন যে, কোহলবার্গ তার গবেষণায় শুধুমাত্র পুরুষ পরীক্ষণপাত্র নিয়ে কাজ করেছিলেন তাই তার তত্ত্ব মেয়েদের নৈতিকতার বিকাশকে প্রতিনিধিত্ব করেনা। তবে নানামুখি সমালোচনা সত্বেও নৈতিকতার বিকাশকে বোঝার জন্য তার তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleভয়, লজ্জা, সংকোচে আপনি যখন অসহায় বোধ করছেন
Next articleনেতিবাচক চিন্তা ও ভয় আপনাকে গৃহে অবরুদ্ধ রাখতে পারে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here