একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা একটি সর্বজনীন মানবিক আবেগ যা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি জটিল এবং ভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেহেতু এর সাধারণ একক কোনো কারণ নেই, এটির সম্ভাব্য প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপঃ- একজন নিঃসঙ্গ শিশু যে স্কুলে বন্ধু বানানোর জন্য চেষ্টা করে, অথবা ধরুন, যার স্ত্রী সম্প্রতি মারা গেছে তাঁর আলাদা এক ভিন্ন চাহিদা রয়েছে।
আলোচ্য লেখাটিতে নিঃসঙ্গতা কী এবং সেইসাথে বিভিন্ন কারণ, স্বাস্থ্যে এর প্রভাব, লক্ষণ এবং একাকীত্বের সম্ভাব্য চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
নিঃসঙ্গতা কী?
যদিও একাকীত্বের সাধারণ সংজ্ঞাগুলো এটিকে নিঃসঙ্গতা বা একা থাকার অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করে, কিন্তু একাকীত্ব আসলে একটি মনের অবস্থা। একাকীত্ব মানুষ নিজেকে শূন্য, একা এবং অবাঞ্ছিত মনে করে। যারা নিঃসঙ্গ তাঁরা অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখার ইচ্ছা করে। কিন্তু মানসিক একাকীত্বের কারণে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়না।
গবেষকগণ পরামর্শ দেন যে, একাকীত্বতা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দূর্বলতা, সামাজিক দক্ষতা, অন্তর্মুখীতা এবং বিষণ্নতার সাথে যুক্ত।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, কোনো মানুষের পক্ষে একা থাকা সম্ভব না। কিন্তু আপনি যদি বিচ্ছিন্নতাবোধ করেন তাহলেই আপনার মনের মধ্যে একাকীত্ব মনোভাব গড়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপঃ- কলেজের একজন নবীন, রুমমেট এবং অন্যান্য সহকর্মীদের দ্বারা বেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও একাকীত্ব বোধ করতে পারে। একজন সৈনিক তাদের সামরিক কর্মজীবন শুরু করতে পারে অন্য বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ক্রমাগত ঘিরে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে একাকীত্ব বোধ করতে পারে।
একাকীত্ব বনাম নির্জনতা
যদিও গবেষণা স্পষ্টভাবে দেখায় যে একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, একা থাকা একাকী হওয়ার মতো নয়। প্রকৃতপক্ষে, নির্জনতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে। যেমন- মানুষ কোন একটা নির্দিষ্ট দিকে নিজেকে ফোকাস করতে পারে এবং এটা নতুন কিছু ভাবতে সাহায্য করে।
সামাজিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও একাকীত্ব বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত। এটি প্রায়ই একটি অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ, প্রত্যাখ্যান বা অন্য লোকের দ্বারা পরিত্যাগ হিসেবে অনুভূত হয়।
অন্যদিকে নির্জনতা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী। যে লোকেরা নিজেরাই সময় কাটানো উপভোগ করে তারা ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখে যেখানে তারা যোগাযোগের আকাঙ্ক্ষায় ফিরে আসতে পারে। তারা অন্যদের সাথে সময় কাটায়, কিন্তু এই মিথস্ক্রিয়াগুলি শুধুমাত্র সময়ের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ।
একাকীত্বের কারণ
নিঃসঙ্গতার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে পরিস্থিতিগত পরিবর্তনশীলতা, যেমন শারীরিক বিচ্ছিন্নতা, নতুন স্থানে চলে যাওয়া এবং বিবাহ বিচ্ছেদ।
উপরন্তু, এটি একটি মানসিক ব্যাধি যেমন বিষণ্নতার লক্ষণ হতে পারে। হতাশা প্রায়ই মানুষকে সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে, যা বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, একাকীত্ব এমন একটি কারণ যা বিষণ্নতা বাড়াতে পারে।
নিঃসঙ্গতা অভ্যন্তরীণ কারণ যেমন কম আত্মসম্মানকেও দায়ী করা যেতে পারে। যেসব লোকের নিজের প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে তারা প্রায়ই বিশ্বাস করে যে, তারা অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ বা বিবেচনার অযোগ্য, যা বিচ্ছিন্নতা এবং দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে।ব্যক্তিত্বের কারণগুলিও ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপঃ- অন্তর্মুখীদের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং খোঁজার সম্ভাবনা কম, যা বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের অনুভূতিতে অবদান রাখতে পারে।
একাকিত্বের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি
নিঃসঙ্গতা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যার মধ্যে রয়েছেঃ
অ্যালকোহল এবং মাদকের অপব্যবহার
পরিবর্তিত মস্তিষ্কের কার্যকারিতা
আলঝেইমার রোগের অগ্রগতি
অসামাজিক আচরণ
কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং স্ট্রোক
স্মৃতিশক্তি হ্রাস
বিষণ্নতা এবং আত্মহত্যা
মানসিক চাপের মাত্রা বৃদ্ধি
দূর্বল সিদ্ধান্ত গ্রহণ
তবে এগুলো একমাত্র কারণ নয়।এর সাথে অনেক বিষয় সম্পর্কযুক্ত রয়েছে। যেমন- যাদের চর্বি বেশি, ঘুম কম হয়, ক্লান্তি, অবসাদ অনুভব করেন তাঁরা মূলত বেশি একাকীত্ব অনুভব করেন।
নিঃসঙ্গতা নিয়ে গবেষণা কী বলে
যারা কম একাকীত্ব মনে করেন তাদের বিবাহ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাদের আয় বেশি এবং সামাজিক মর্যাদা বেশি। একাকীত্ব ব্যক্তি ছোট সামাজিক নেটওয়ার্ক, নিম্নমানের সামাজিক সম্পর্ক, একা থাকা, ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একাকীত্ব মোকাবেলায় সাহায্য করে
পরিসংখ্যান বলছে, একাকীত্ব ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে তরুণ প্রজন্মের মাঝে একটি জরিপ করা হয়েছে যেখানে ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী ২৫% প্রাপ্ত বয়স্কদের কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই এবং রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, ২২% ব্যক্তিদের কোনো বন্ধু নেই। এছাড়া ইন্টারনেটের উত্থান, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি একাকীত্ব বাড়ানোর জন্য দায়ী।
একাকীত্ব ছোঁয়াচে হতে পারে
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, একাকীত্ব আসলে সংক্রামক হতে পারে। এছাড়া যারা নিঃসঙ্গ মানুষের সাথে সময় কাটায় তাদের একাকীত্ব অনুভব করার সম্ভাবনা বেশি।
একাকীত্ব প্রতিরোধ এবং কাটিয়ে ওঠার উপায়
একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তবে ব্যক্তির সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ব্যক্তিকে সুখী, স্বাস্থ্যকর এবং মনে ইতিবাচকতা আনতে ভূমিকা রাখে।
কমিউনিটি সার্ভিস বা অন্য কোন কার্যকলাপ যা আপনি উপভোগ করেন তা বিবেচনা করুন। এই পরিস্থিতিগুলি মানুষের সাথে দেখা করার এবং নতুন বন্ধুত্ব এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া গড়ে তোলার দুর্দান্ত সুযোগ দেয়। মানসম্মত সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিন। আপনার সাথে অনুরূপ মনোভাব, আগ্রহ এবং মূল্যবোধ ভাগ করে এমন লোকদের সন্ধান করুন। প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। রাতারাতি জিনিস পরিবর্তনের আশা করবেন না, তবে আপনি এমন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করতে পারেন যা আপনার একাকীত্বের অনুভূতি দূর করতে এবং আপনার প্রত্যাশাকে সমর্থন করে। আপনার জীবনে একাকীত্বের প্রভাবগুলি বুঝতে পারেন। একাকীত্বের জন্য শারীরিক এবং মানসিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আপনি যদি অনুভব করেন যে এই উপসর্গগুলির মধ্যে কিছু আপনি চিনতে পারেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা করুন। একটি গ্রুপে যোগ দিন অথবা আপনার নিজের গ্রুপ শুরু করুন। উদাহরণস্বরূপঃ- আপনি একটি মিটআপ গ্রুপ তৈরি করার চেষ্টা করতে পারেন যেখানে আপনার এলাকার অনুরূপ স্বার্থের লোকেরা একত্রিত হতে পারে। আপনি একটি কমিউনিটি কলেজে ক্লাস নেওয়া, একটি বই ক্লাবে যোগদান, বা একটি ব্যায়াম ক্লাস নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। বর্তমান সম্পর্ক শক্তিশালী করুন। নতুন সম্পর্ক তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আপনার বিদ্যমান সম্পর্কের উন্নতি করাও একাকীত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে। আপনার বন্ধু বা পরিবারের সদস্যকে কিছুক্ষণের মধ্যে কল করার চেষ্টা করুন। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন এমন কারো সাথে কথা বলুন। আপনি যা অনুভব করছেন সে সম্পর্কে কথা বলতে আপনার জীবনে কারও কাছে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন একজন হতে পারে যাকে আপনি জানেন যেমন পরিবারের সদস্য, কিন্তু আপনি আপনার ডাক্তার বা একজন থেরাপিস্টের সাথে কথা বলার কথাও ভাবতে পারেন। অনলাইন থেরাপি একটি দুর্দান্ত বিকল্প হতে পারে কারণ এটি যখনই আপনার জন্য সুবিধাজনক তখন আপনি একজন থেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।
শেষ কথা, একাকীত্ব মানুষকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এটি মনের একটি জটিল অবস্থা যা জীবনের পরিবর্তন, মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, দুর্বল আত্মসম্মান এবং ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের কারণে হতে পারে। নিঃসঙ্গতার কারণে মানসিক সুস্থতা এবং শারীরিক সমস্যা হ্রাস সহ গুরুতর স্বাস্থ্যের পরিণতি হতে পারে।
রেফারেন্সঃ
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে