নারীর মানসিক স্বাস্থ্য: ঘরে বাইরে সমস্যা

0
8
নারীর মানসিক স্বাস্থ্য: ঘরে বাইরে সমস্যা

ডা. সাদিয়া আফরিন
এম.ডি. রেসিডেন্ট (ফেইজ-এ), চাইল্ড এ্যান্ড এডোলোসেন্ট সাইকিয়াট্রি,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

নারীর অধিকার যে সকল পরিমাপক দিয়ে মাপা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য যা এখনও আমাদের সমাজে নতুন শব্দ হিসেবেই বিবেচিত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সবার মৌলিক অধিকার। আর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সমন্বয়েই স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

সুতরাং নারীর মানসিক স্বাস্থ্য অবশ্যই গুরুত্বের দাবি রাখে এ কারণে যে, একজন নারী তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে- কারো না কারো স্ত্রী, কারো বোন, কারো মেয়ে। এ তো গেলো পারিবারিক পর্যায়ের ভূমিকা: সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে তার ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীতে যা কিছু কল্যাণকর, তার অর্ধেক কৃতিত্ব যে নারীর তা কবির সাথে সাথে আমরাও আজ স্বীকার করতে বাধ্য।

যুগে যুগে নারীরা যেমন পারিবারিক-সামাজিক- অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বঞ্চনার শিকার হয়েছে, ঠিক তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের বেলায়ও অবহেলার পাত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বয়ঃসন্ধিকাল, মাতৃত্বকালীন সময়সহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোতে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচুর তারতম্য ঘটে। সঠিক জ্ঞান এবং পরিচর্যার অভাবে এ সময়গুলোতে নারীরা মারাত্মক সব মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। তাই প্রথমেই যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো- নারীর মানসিক গঠন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সম্যক একটি ধারণা, এর গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং কী কী ব্যত্যয় ঘটতে পারে সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া।

বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক বড় বড় পরিবর্তনের সাথে সাথে কিশোরীদের মানসিক অবস্থাও থাকে ভঙ্গুর। অর্থাৎ আবেগ, বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি মানসিক বিষয়গুলো অপরিপক্ব থাকে। হরমোনের তারতম্য, হঠাৎ করে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা, পারিবারিক সহযোগিতার অভাব, সঠিক অভিভাবকত্ব না পাওয়া- এরকম নানাবিধ কারণে কিশোরীরা প্রায়ই মানসিক অস্থিরতায় ভোগে।

Magazine site ads

অতিরিক্ত আবেগ, একটুতেই রেগে যাওয়া, নিজেকে মূল্যহীন বা তুচ্ছ ভাবা, পরিণাম চিন্তা না করে হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, শুচিবাই, বিষণ্ণতা, হতাশা, মাদকাসক্ত হওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি (ফেসবুক, ইউটিউব) অতিরিক্ত আসক্তি, নিদ্রাহীনতা, তুচ্ছ কারণে নিজের ক্ষতি করা, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি যেকোনো এক বা একাধিক মানসিক সমস্যার ঝুঁকিতে থাকে ১-১৪/১৫ বছরের কিশোরীরা। বর্তমানে শিথিল পারিবারিক সম্পর্ক, বাবা-মায়ের কলহ কিংবা বিচ্ছেদ, অতিরিক্ত স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

প্রতিটি বিষয় বিশদভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাদের এই সহানুভূতিকাতর সময়টাতে মানসিক পরিচর্যার অভাবেই এতসব সমস্যার উৎপত্তি হয়। কিশোরীদের মানসিক গঠন এ সময় পরিপক্বতার দিকে ধাবিত হয় বলেই, পরিবর্তন হয় বুব দ্রুত। অনেক মেয়েই পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয় কিন্তু অজ্ঞতা কিংবা লোকলজ্জার কারণে বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের কাছে সরাসরি সব কথা বলতে পারে না। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার লক্ষ্যেই বাবা-মাকে যেমন সচেতন হতে হবে ঠিক তেমনি চারপাশের পরিবেশ, সামাজিক পর্যায়েও কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

অন্য একটি স্পর্শকাতর সময় হলো- গর্ভাবস্থা। গর্ভাবস্থা এবং প্রসব-পরবর্তী ১ বছর হরমোনের ব্যাপক তারতম্য, বিভিন্ন প্রকার পারিবারিক ও সামাজিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ইত্যাদি কারণে মায়েদের মধ্যে মানসিক রোগ দেখা দেয়। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা রোগ যেমন-Post partam Blue বা Post partam Depression সম্পর্কে এখন আমরা অনেকেই জানি। গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে গর্ভাবস্থায় প্রতি ১০০ জনে ১০ জন এবং সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ১৩ জন নারী বিষন্নতা রোগে ভোগেন। আমাদের দেশে এই হার আরো বেশি। প্রসব পরবর্তী প্রতি ১০০ জনে ২০ জন নারী বিষন্নতায় ভোগেন।

মাতৃত্বজনিত বিষণ্ণতা রোগের কারণে দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটে, শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়, আত্মহত্যার বুঝুঁকি বেড়ে যায়- সর্বোপরি সন্তানের বৃদ্ধি ও বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মেয়েদের মধ্যে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাও প্রকট যা থেকে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা এখন নেহায়েত কম নয়। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ কর্মস্থলই নারীবান্ধব নয়। একজন নারীকে সংসারের সব কাজ সামলিয়ে বাইরের কাজও করতে হয়। অর্থাৎ ঘরে বাইরে সমান কাজ করতে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে পারিবারিক সহযোগিতার ঘাটতি থাকলে মানসিক চাপের কারণে নানা রকম মানসিক সমস্যার উদ্ভব হয়। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে, গুণগত মান কমে- সর্বোপরি ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

সারা বিশ্বে নারীদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ। আর আত্মহত্যার ৪০% বিষণ্ণতার কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও উদ্বেগ, শুচিবাই, হিস্টিরিয়া, সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে নারীরা বিপদজনকভাবেই আছেন। কিন্তু নারীরা লোকলজ্জা, কুসংস্কার, পরনির্ভরশীলতা, নিজেদের অজ্ঞতার কারণেই নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলিত কিংবা অবহেলার শিকার। এছাড়া রয়েছে পরিবারের লোকদের মনোযোগের অভাব।

উত্তরণের পর্যায়গুলো তাই ধাপে ধাপে নারীরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরো অধিক সচেতনতা লাভ করলে নিজেই নিজেকে প্রথম সাহায্যটুকু করতে পারবে।পারিবারিক পর্যায়- পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নারীদের প্রতি (মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ের) প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে। সাংসারিক চাপ একা যেন নারীকেই বহন না করতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

যেকোনো সংকটের মুহূর্তে পারিবারিক পরিচয় ও সমর্থন লাভ জরুরি। কোনো মানসিক সমস্যা হলে পারিবারিক প্রভাবেই তার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও সম্পন্ন করা উচিৎ।সামাজিক পর্যায়- কর্মস্থল বন্ধুসুলভ করা। নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া- সর্বোপরি সহযোগিতার মনোভাব থাকা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে যেমন- নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মানসিক সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারসমূহ নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগের চিকিৎসাসমূহের অবকাঠামো ও গুণগত উন্নয়ন ইত্যাদি।

আমাদের দেশে নারীরা পুরুষের তুলনায় মানসিক রোগে বেশি ভোগেন, কিন্তু দেশের প্রধান দুটি মানসিক হাসপাতালে নারীদের জন্য শয্যা সংখ্যা অনেক কম। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ২০০ শয্যার মধ্যে নারীদের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৬৯টি শয্যা, যেখানে শিশুরাও ভর্তি হয়। অন্যদিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৫০০টি শয্যার মধ্যে নারী রোগীদের জন্য বরাদ্দ মাত্র ১০০টি শয্যা। মানসিকভাবে অসুস্থ নারীর যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার পথে বাধা- লোকলজ্জা, কুসংস্কার আর পরিবারের অবহেলা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সাধারণ মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ বুঝতে ২০১৭ সালে এলাকাভিত্তিক (২টি এলাকা) জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ৩৩% লোক বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, শুচিবাইসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। যার মধ্যে নারীদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে ৩৩ লাখ ৯১ হাজার মানুষ বিষাদগ্রস্ত যা মোট জনসংখ্যার ৪.১% এবং পুরুষের তুলনায় নারীরাই অধিক আক্রান্ত।

বাংলাদেশের ২০-২৯ বছর বয়সী নারী পোশাক শ্রমিকদের ওপর পরিচালিত একটা জরিপে দেখা যায়- শতকরা ৪৩ ভাগ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রজনিত মানসিক চাপে ভুগছেন। নেপোলিয়ন যেমন একজন শিক্ষিত মা চেয়েছিলেন শিক্ষিত জাতি উপহার দেওয়ার জন্য তেমনি একটি সুস্থ সুন্দর সফল উন্নত জাতির জন্য একজন পরিপূর্ণ সুস্থ (শারীরিক ও মানসিক উভয়ই) মা প্রয়োজন।

Previous articleসকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here