বর্তমানে আমরা পার করছি উত্তরাধুনিক সময়। বিংশ শতাব্দীর মাঝের থেকে শেষের দিকে শুরু হয়েছে উত্তরাধুনিক কাল। এই সময়ের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে আমাদের পেশা, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, দায়িত্ববোধ, সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।
বর্তমান সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে কৃষিকাজের প্রতি নির্ভরশীলতার অনুপাত কমছে, বেড়ে যাচ্ছে চাকরি, ব্যবসা। মানুষ ক্রমাগত নগরমুখী হচ্ছে। পেশার ক্ষেত্রে বেসরকারি এবং খন্ডকালীন পেশা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সময়ের দিক থেকেও কাজের সময় হয়ে উঠছে যেকোনো রকম। খন্ডকালীন পেশা পরিবর্তন করা সহজ হলেও এটাতে থাকছে না কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং অবসরকালীন ভাতা। যার ফলে একটা অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।
লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। এক ব্যক্তি বহু কাজ পারলে পেশার ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা বেশি হয়ে উঠছে। তাই চলছে ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ’-যেই কর্মী জুতো সেলাইয়ের দামে করে দিচ্ছেন তিনিই প্রতিষ্ঠানে যোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। তবে অতিরিক্ত চাপের কারণে কোনো সমস্যায় পড়লে তার আর মূল্য থাকছে না পেশাগত জীবনে। কাজের সময় এখন হয়ে যাচ্ছে রাতের বেলা, ছুটির দিন, যার ফলে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রাখাটাই একটা চাপের বিষয় হয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি বড় পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে উঠছে। এর সুবিধার পাশাপাশি অনেক অসুবিধা মানুষকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। পৃথিবী এক অর্থে ছোট হয়ে উঠছে প্রযুক্তির কল্যাণে, আবার দূরে ঠেলে দিচ্ছে পাশাপাশি মানুষদের। এক দম্পতি বলছিলেন, ‘আমাদের চার বছর হলো বিয়ে হয়েছে, ফেসবুকে অনেক ছবি আছে, কিন্তু নিজেরা নিজেদের দিকে তাকানোর বা অুনভব করার সময়ই পাইনি’।
আবার অনেক মা- বাবা দুঃখ করছেন শুনতে পাই-‘বাচ্চাকে নিয়ে দাওয়াতে গেলাম। চার পাঁচজন সমবয়সী বাচ্চা সেখানে যে যার মতো মোবাইল টিপছে, কেউ কথাও বললো না সেভাবে, কেউ খেললও না’। এই সমস্যা শুধু শহরে না, মফস্বল এবং অনেক গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে সমানভাবে। কারণ পণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে বেশ কম দামেই মোবাইল সবার হাতের নাগালে এসে গেছে।
সব কিছু মিলিয়ে পুরনো অনেক প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন এখন চাপের মুখে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এই পরিবর্তনের গভীর প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতবাদী আলভিন টফলার [Alvin Toffler (October 4, 1928- JUNE 27, 2016) তাঁর ১৯৭০-এ প্রকাশিত বহুল পঠিত বই Future Shock বইটিতে এই অবস্থাকে উল্লেখ করেছেন এভাবে ‘অল্প সময়ে অনেক বেশি পরিবর্তনের অভিজ্ঞতায় সমাজ এবং ব্যক্তি একটা হতবিহ্বল অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে’। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ক্রমাগত অনিশ্চয়তা, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতা, উদ্দেশ্যহীনতা বাড়িয়ে তুলছে মানসিক চাপ।
এই অবস্থায় কীভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে আমরা অনেকখানিই চাপ মোকাবেলা করতে পারি।
- নিজস্ব একটি স্থিরতার স্থান রাখা: এটা হতে পারে নিজের পরিবার, জীবনসঙ্গী কাছের এক-দুইজন বন্ধু- বান্ধব। চারপাশের অনেক পরিবর্তনের ভিড়ে তারা কাজ করবে স্থির একটি দ্বীপের মতো। যেকোনো পরিবর্তন অসহনীয় হতে লাগলে এই স্থানে ভরসা পাওয়া যাবে। যেমন চারপাশের নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যে নিজেকে খুব অসহায়বোধ করা একজন ব্যক্তি বলছিলেন তার স্ত্রী আর সন্তান তাকে সবসময় নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছে নিজস্ব নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে।
- নিজের ইতিবাচক দিকগুলোকে দেখা: যত ছোটই মনে হোক না কেন নিজের ইতিবাচক দিকগুলোর একটা তালিকা করে সেটা মনে রাখলে অনেক চাপের বিষয় সঠিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। ইতিবাচক দিক হতে পারে কোনো দক্ষতা, কোনো মনোভাব।
- ইতিবাচক কাজ: যেকোনো ইতিবাচক কাজ যেমন ব্যায়াম করা, বই পড়া, গান শোনা, রান্না করা, ঘর গোছানো, গাছের যত্ন নেয়া ইত্যাদি। যে কাজগুলো অন্য কারো ক্ষতি করে না কিন্তু নিজেকে আনন্দ দেয় সেগুলোর জন্য সময় দেয়া।
- ভূমিকা রাখা: এমন কোনো কাজ যেটা ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া অন্যের জন্য অথবা সমাজের জন্য ভূমিকা রাখে। যেমন-নিজের এলাকার রাস্তাঘাটের চলাচলের অনুপযোগিতা যখন চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন এই ব্যাপারে অনেকে সমন্বিত হয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কাজ করে এই অসুবিধা দর করা।
- সরাসরি সামাজিক যোগাযোগ: পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী এরকম বিভিন্ন সম্পর্কগুলোতে সরাসরি যোগাযোগের জন্য সময় রাখা। এতে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ঝুঁকিও কমে আসে।
- তুলনা করা: আশেপাশে তাকালে দেখা যাবে নিজের চেয়ে অনেকে বেশি কষ্টে আছে, তাদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করলে নিজের জীবনের ভালো দিকগুলো চোখে পড়বে এবং চাপ মোকাবেলা সহজ হবে। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে ‘নিজের কী আছে’, ‘নিজে কতটা সুখী’ এই চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেন, নিজে সেরকম পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সব ক্ষেত্রে জীবনের এক দিক দেখা যায়, কিন্তু এর বিপরীত দিকে অর্থাৎ সরাসরি সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে নিজের চেয়ে অনেকেই অনেক কষ্ট-বঞ্চনায় জীবন পার করছেন।
- দৈনন্দিন কিছু সময় নিজেকে একান্তভাবে দেয়া। নিজের ধর্মীয় রীতি পালন, ধ্যান চর্চা মানসিক প্রশান্তি এনে দিতে পারে।
- এখনকার যুগে আমরা একসঙ্গে বহুকাজ করার একটা মনোভাব নিয়ে চলছি। তবে যেকোনো একটা কাজে দক্ষতা অর্জন নিজেকে সত্যিকার অর্থে আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ় করে তুলতে পারে। ‘জ্যাক অফ মেনি ট্রেড, মাস্টার অফ ওয়ান’ হয়ে উঠলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থিরতা পাওয়া সম্ভব হবে।
- ঘুমের নির্দিষ্ট সময় পালন: যাদের কোনো নৈশকালীন পেশা পালন করতে হচ্ছে না তাদের রাতের বেলা ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এর কম-বেশি কোনোটাই মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। যাদের রাতের বেলা কোনো পারিবারিক (যেমন : নবজাতকের মা-বাবা, স্মৃতিভ্রংশতার রোগের পরিচর্যাকারী) অথবা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে- তাদের জন্য দিনে সময় বের করে ঘুমিয়ে নিতে হবে। সুবিধার বিষয় হচ্ছে দিনে এই ঘুমটাই তিন-চার ঘণ্টায় যথেষ্ট হয়ে যায়।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা: শাক-সবজি, ফল, যথেষ্ট পরিমাণে পানি খাওয়া শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো থাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। একদম শোয়া-বসার জীবনযাত্রা বিভিন্ন রোগের ঝঁকি বাড়িয়ে মানসিক চাপের ক্ষেত্র তৈরি করে। তাই যতটা পারা যায় হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম করে সচল জীবনযাত্রা রাখা।
- পানিতে পড়ে ডুবে যেতে থাকলে নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকে, কিন্তু হাত-পা ছঁড়তে ছঁড়তে একসময় সাঁতার কাটতে পারলে ভেসে ভেসেই এগোনো যায়, তখন নিজেকে আর অসহায় মনে হয় না। তাই বর্তমান সময় কঠিন মনে হলেও, সামাজিক এবং বৈশ্বিক অনেক পরিবর্তন এখন অসহনীয় মনে হলেও নিজের চাপ মোকাবেলা করার পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে থাকলে অনেকখানিই অনিশ্চয়তা, অসহায়ত্ব কাটিয়ে ওঠা যাবে।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে