দাম্পত্যঃ ভালো লাগা, ভালো থাকা

দাম্পত্য জীবনের মূল কথা হচ্ছে বিয়ে। বিয়ে এমন একটি ঘটনা যার মাধ্যমে দুই জন মানুষের ভেতরের সম্পর্ক আইনগত, ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে স্থায়িত্ব লাভ করে। পূর্ণবয়স্ক দুইজন নারী ও পুরুষ একসঙ্গে মানসিক ও শারীরিকভাবে একাত্ম জীবনযাপনের জন্য দাম্পত্য জীবনকে বেছে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশা থাকে যে, জীবনের শেষ পর্যন্ত তারা সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকবে।

সংসার জীবন কোনো সরলরৈখিক রাস্তা নয়। দাম্পত্য জীবনকে তুলনা করা যেতে পারে অনেকটা গিরিখাতবহুল পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তার সাথে। আপনি কখনোই পুরোটা সময় একইরকম আয়েশে পার করতে পারবেন না! অনাকাঙ্ক্ষিত দাম্পত্যকলহ এড়ানো যায় না অনেক সময়। এর মনোজাগতিক ও আর্থ-সামাজিক যথার্থ ব্যাখ্যা রয়েছে। সেইসব বিষয়াদি সম্পর্কে ধারণা থাকলে অনেক সহজেই আমরা দাম্পত্যের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে পারি।

বিয়ে ও তার পরবর্তী দাম্পত্য জীবনের আবির্ভাব কখন হলো তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট সময়সীমা জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, খুব প্রাচীনকাল থেকেই এর চর্চা হয়ে আসছে। মানব প্রজাতির টিকে থাকা, বংশবিস্তার বা গোত্রের শক্তি বৃদ্ধি-এসব কারণে এর উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। তবে সময়ের পরিক্রমায় দাম্পত্যের মনস্তাত্ত্বাতিক সম্পর্ক কখোনোই একরকম ছিল না। প্রাচীন গ্রিসে বিয়েতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার, রোমে রাজনৈতিক সুবিধা, মধ্যযুগের ইউরোপে পারিবারিক সিদ্ধান্ত এইসবের ভিত্তিতে বৈবাহিক জীবন নির্ধারিত হতো।

আঠারো শতকের দিক থেকে বিয়েতে ভালোবাসার ব্যাপারটা স্বীকৃত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বিংশ শতকের দিকে এসে পাল্টাতে থাকে দাম্পত্যের হিসাব-নিকাশ। বলা হয়ে থাকে, দাম্পত্য জীবন যেমন কারো জন্য সবচেয়ে বেশি সুখের উৎস হতে পারে তেমনি অশান্ত দাম্পত্য গভীর দুর্দশাও তৈরি করতে পারে। তবে সব দাম্পত্য যেমন একরকম নয়, সেরকম একই দাম্পত্যও সময়ের পরিক্রমায় একই রকম থাকে না। জীবন চক্রের মতোই তা একেক সময় একেক রূপ নেয়।

দাম্পত্যের জীবন চক্র
সময়ের সাথে সাথে দাম্পত্যকে বহু ঘাত-প্রতিঘাত পার করতে হয়। তবে স্বামী-স্ত্রীর সবচেয়ে সুখের কাল হলো তাদের প্রথম সন্তান জন্মের আগের সময়টুকু। এটা হলো সর্বোচ্চ আবেগের সময়। প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক গতানুগতিক রূপ ধারণ করে। অর্থনৈতিক চাহিদা ও বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব মিলিয়ে চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ। দাম্পত্য সম্পর্কে যারা বন্ধুর মতো একে অপরের পাশে থেকে অভ্যস্ত তারা পিতা-মাতার দায়িত্বকে উপভোগ করতে পারেন। সন্তান তাদের জীবনে নতুন মাত্রার সূচনা করে। মজার ব্যাপার হলো, সন্তানরা বড়ো হয়ে নিজস্ব জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, এই দাম্পত্য সম্পর্কের গভীরতা আবার কিছুটা বাড়ে। এই সময়ে দম্পতিরা তাদের অতীত জীবন, তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতিনাতনিদের নিয়েই অধিকাংশ সময় গল্প করেন।

আসলে দাম্পত্য কেমন হবে তা অনেকখানি নির্ভর করে কী ধরনের বিয়ে হচ্ছে তার ওপর। মূলত বিয়েকে দুই শ্রেণিতে ফেলা যায়। এক. এক্ষেত্রে বিয়ে হয় পারস্পরিক ভালোবাসা, পরস্পরের মূল্যবোধের প্রতি সম্মান থেকে। তবে পারস্পরিক ভালোবাসা বা রোমান্টিসিজম থেকে উদ্ভুত যে বৈবাহিক জীবন তা কিছুটা সংবেদনশীল। এখানে ভালোবাসার অনুভূতিই মূল ভিত্তি। কোনো কারণে এর ঘাটতি দেখা দিলে দাম্পত্য সংঘাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে এ ধরনের বিয়েতে স্বামী-স্ত্রী বেশি সন্তুষ্ট থাকে। দুই. এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় জড়িত থাকে যেমন-সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সুবিধাসহ আরো অনেক বৈষয়িক বিষয়। এখানে আবেগ, অন্তরঙ্গতা মূল বিষয় নয়। কিন্তু সম্পত্তি, সামাজিক মর্যাদা, সন্তান ইত্যাদি বন্ধন এখানে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কাজ করে। এ ধরনের বিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়।

দাম্পত্যের রকমভেদ
কনফ্লিক্ট অ্যাভয়ডারস : এদের দাম্পত্যে কিছু ব্যাপার থাকে, যেখানে তারা পরস্পরনির্ভর। তবে তাদের নিজস্ব জগত থাকে যেখানে একে অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

ভোলাটাইল কাপলস : এখানে আবেগ বা ইমোশন বেশি কাজ করে। তারা সবসময় একে অন্যের সাথে লেগে থাকে, তর্ক-বিতর্ক করে, কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।

ভ্যালিডেটিং কাপলস : এরা একে অন্যের থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পরস্পরের অবস্থা বোঝে ও সহানুভূতিশীল থাকে। কোনো বিষয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লেও পরে ছাড় দেয়।

হস্টাইল কাপলস : এই ধরনের দাম্পত্যে সবসময় আক্রমণ, প্রতিরক্ষাসুলভ আচরণ, সমালোচনা, একে অন্যের অবস্থা না বোঝা, হিংসা-দ্বেষ থাকে।

হস্টাইল ডিটাচড কাপলস : এ ধরনের সম্পর্ক মোটামুটি অচলাবস্থায় থাকে। পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ও আবেগীয় সম্পর্ক থাকে না। এখানে বিবাহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনা প্রবল থাকে।

দাম্পত্যে যৌনজীবন
দাম্পত্যে সম্পর্কে শারীরিক মিলনের ব্যাপারে নারী ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই ভিন্ন। পুরুষের আগ্রহ তার দাম্পত্য সম্পর্কের অবস্থা দিয়ে তুলনামূলক কম প্রভাবিত হয়। অধিকাংশ পুরুষ এটাকে তাদের শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা মনে করেন না। এর কারণ অনেক পুরুষই তাদের জীবনের এক অংশের কোনো সমস্যাকে জীবনের অন্য অংশে প্রভাব ফেলতে দেন না। যেমন আর্থিক সমস্যা, চাকুরির সমস্যা বা রাগারাগির ক্ষেত্রেও তাদের কাছে যৌনতা একটি টেকসই আনন্দের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।

আবার অনেক পুরুষ যৌনজীবনের ওপর ভিত্তি করেই তাদের দাম্পত্য জীবনকে মূল্যায়ন করে থাকেন। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই ভিন্নরকম। তাদের জীবনের বিভিন্ন বিষয় তাদের যৌনজীবন ও আগ্রহকে প্রভাবিত করে। যদি স্বামীর সাথে কোনো কারণে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়, তাদের সম্পর্কের মাঝখানে কোনো চাপা সমস্যা থাকে তাহলে মেয়েদের জন্য বিষয়টা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অন্যদের সাথে খারাপ সম্পর্ক বিশেষত শ্বশুড়বাড়ির সাথে টানাপোড়েন, তার যৌনজীবনকে প্রভাবিত করে। তারা পুরুষদের মতো ব্যাপারটাতে সহজ হতে পারে না। মেয়েদের সন্তানের পরিচর্যা, সাংসারিক কাজ, সামাজিক দায়িত্বে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। এত কাজের ক্লান্তিও তাদের আগ্রহকে নষ্ট করে ফেলে। এরকম অবস্থায় পরস্পরের চাহিদার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময়ই এটা মেয়েদের ওপর চাপ তৈরি করে, তারা এটাকে দায়িত্ব হিসেবে নেয় এবং যথেষ্ট বিরক্তির সাথে তা করতে বাধ্য হয়।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে-নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে চিন্তা। অধিকাংশ স্ত্রীই তাদের শারীরিক গঠন ও সৌন্দর্য নিয়ে মনে মনে অসন্তুষ্ট থাকেন। তখন তার পক্ষে শারীরিক মিলন অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এটা খুব সহজেই কাটানো সম্ভব। স্বামী তার স্ত্রীকে যদি এটা বলে বা বুঝিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেন যে, তার চোখে সে অনেক বেশি সুন্দর! সেটা তার স্ত্রীর অস্বস্তি অনেকাংশেই দূর করতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই সমস্যা সমাধানের আরেকটি উপায় হচ্ছে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি কথা বলা।

এর ফলে দুইজনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বাস তৈরি হয়। চাইলে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক কৌশল তৈরি করা যায়। পরস্পরের পছন্দ ও অপছন্দকে জানা ও সেগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, আলোচনার সময় গঠনমূলক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো। এছাড়াও ধৈর্য ধারণ করা, ছাড় দেয়া, স্ত্রীকে দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করা দাম্পত্য সম্পর্কের অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারে। স্ত্রীকে দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করলে তার চাপ অনেকখানি কমে যায় আর নিজেদের জন্য কিছুটা সময়ও বের করা সম্ভব হয়। সোজা কথায় আপনি যদি স্ত্রীকে আপনার মতো করে পেতে চান, তবে আপনাকেও আপনার স্ত্রীর মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আবার স্ত্রীরাও যদি স্বামীর চাপ কিংবা সংকটগুলোকে নিজের বলে ভাবেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন, পরামর্শ দেন সেটিও সম্পর্ককে আস্থাশীল করে তুলতে পারে।

দাম্পত্যকে মসৃণ রাখার সহজ কিছু উপায়-

  •  দাম্পত্যের ভেতরে বিরাজমান দ্বন্দ্বের নিরসন করতে হবে ও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অন্তরঙ্গতা বাড়াতে হবে।
  •  সঙ্গী/সঙ্গিনীকে জানার চেষ্টা করুন : আপনার সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীর মনোজগত এবং বহির্জগত সম্পর্কে জানার জন্য সত্যিকারের উৎসাহ দিন ও আগ্রহ দেখান। তার স্বপ্নের কথা, জীবনের লক্ষ্যের কথা জানার চেষ্টা করুন।
  • তার প্রশংসা করুন, সহমর্মিতা দেখান এবং তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিন।
  • তার আচরণের ছোটো ছোটো ভালো বিষয়গুলো খেয়াল করুন এবং তাকে বুঝতে দিন যে আপনি সেটা খেয়াল করছেন। একসময় সে-ও একইরকম করবে।
  • নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় রাখুন। বন্ধুত্ব দাম্পত্যের দ্বন্দ্ব নিরসনে সাহায্য করে।
  • সমস্যা জটিল হওয়ার আগেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে সচেষ্ট থাকুন।
  • নিজের কোনো আচরণ ভুল হয়ে থাকলে কিংবা সচেতন-অচেতনভাবে আঘাত দিয়ে থাকলে সেটি অকপটে স্বীকার করুন, দুঃখ প্রকাশ করুন।
  • সঙ্গী/সঙ্গিনীকে অন্য কারো সাথে তুলনা করে হেয় করা, বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের অন্য সদস্য বা সন্তানদের সামনে শ্লেষাত্মক, বিদ্রুপাত্মক বা অপমানজনক কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
  • পরস্পরের পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। শুধু স্ত্রী-ই স্বামীর পরিবারের দেখাশোনা করবেন এমনটা ভাববেন না, স্বামীদেরও স্ত্রী’র পরিবারের সাথে একাত্ম হওয়া জরুরি।
  • সন্তানের দৈনন্দিন দায়িত্ব ভাগ করে নিন, সন্তানের অসুস্থতা বা ছোটো-বড়ো দুর্ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করবেন না।

সম্পর্কের ব্যাপারে দুইজনেই সমান দায়িত্ববান হোন। কয়েক ধরনের ব্যবহার রপ্ত করা সুখী, স্বাস্থ্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন। তা হলো-ভালোবাসুন ও হ্যাঁ বলার অভ্যাস করুন, ক্ষমাশীল হোন ও ক্ষমা চাইতে শিখুন, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করুন, অন্যের কথা শুনতে শিখুন আর ছোটো-খাটো দাম্পত্য সমস্যায় শান্ত থাকতে শিখুন। সুস্থ, সুখী দাম্পত্য সবসময়ই একটি আকাক্সিক্ষত বিষয়। প্রায় প্রতিটি মানুষ এই স্বপ্নই দেখে। আমাদের সচেতনতা ও সতর্ক আচরণ সুস্থ ও দীর্ঘজীবী দাম্পত্য জীবনের অনেকটা নিশ্চয়তা দিতে পারে।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleগবেষণা: ভালোবাসা থাকলে যৌনতা জরুরী নয়
Next articleসুখী এবং সুস্থ জীবনের জন্য বন্ধুত্বের গুরুত্ব এবং সঠিক বন্ধু নির্বাচনে কিছু টিপস
ডা. সৌবর্ণ রায় বাঁধন
রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here