মনের আনন্দে কিংবা রেগে গিয়ে মাথা থেকে দুএকটা চুল তুলে ফেলা, অথবা নাতী নাতনী দিয়ে মাথার চুল উঠানো খারাপ কিছু নয়, আরাম আছে। কিন্তু মনের অজান্তে কিংবা জানামতে এক এক করে চুল তুলতে তুলতে বিরাট একটা অংশ খালি করে ফেলা নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। ‘ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া’ এমনি একটি মানসিক রোগ যেখানে, নিজে নিজেই টেনে টেনে চুল তুলে ফেলেন।
ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া (বা চুল তোলা রোগ)
এটি এমন একটি মানসিক রোগ যেখানে রোগী বা আক্রান্ত মানুষটি নিজেই তার চুল টেনে টেনে তুলে ফেলেন। তুলতে তুলতে একটা বিশাল জায়গা খালি করে ফেলেন। বিষয়টি এমন না যে, হঠাৎ একদিন বসে বসে এক সাথে অনেক চুল তুলে ফেললেন। এ কাজটি তিনি অনেক দিন ধরে করেন এবং করতেই থাকেন। ইচ্ছে করেও সে অভ্যাস বা কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না।
প্রথম প্রথম হয়তো বিষয়টিকে কোন সমস্যা মনে করেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা যায় তিনি নিজেই সে আচরণ থেকে আর বিরত থাকতে পারছেন না। বুঝে শুনেই অথবা অজান্তে চুল তুলতেই থাকেন। বিরত থাকার চেষ্টা করলে মনের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব তৈরি হয়। চুল তোলার পর পর সাময়িক একটু স্বস্তি অনুভব করলেও বেশিরভাগ সময়েই সেটা কষ্ট ও অস্বস্তির কারণ হিসেবেই থেকে যায়। দেখা যায়, ধীরে ধীরে বিরাট একটা অংশ খালি হয়ে যায়। বর্তমানে এই রোগটিকে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের একটি অংশ হিসেবে ধরা হয়।
অনেকে বলেন, চুল তোলার বিষয়টিতে আক্রান্ত মানুষটি কোন ব্যথা অনুভব করেন না। অনেকে বলেন, তাদের ব্যথার অনুভূতি কমে যায়। কেউ কেউ এই চুল তোলার ভেতর দিয়ে অন্য টেনশন বা এনজাইটিকে প্রশমিত করেন, এমন কথাও আছে।
কাদের হয়, কখন হয়?
নারী পুরুষ দুজনেরই এ রোগ হতে পারে। তবে তুলনামূলক ভাবে মেয়েদেরই বেশি হয়। সাধারণত দেখা যায় ১২-১৩ বছর বয়সে এ রোগের শুরু হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আগেও দেখা দিতে পারে (২-৬ বছর), তবে সেসবের বেশিরভাগই কিছুদিনের ভেতর সেরে যেতে দেখা যায়।
এ রোগের প্রকোপ একই পরিবারের বিভিন্ন মানুষের ভেতর দেখা যায়। তাই হেরেডিটরি লিংক আছে বলে ভাবা হয়। নিউরোট্রান্সমিটার, সেরোটোনিন ও ডোপামিনের সমস্যার কারণে এগো হয় বলে ধরা হয়ে থাকে। বিড়াল, কুকুর কিংবা ঘোড়ারও একই রকম সমস্যা হয়ে থাকে।
কোন কোন জায়গার চুল তুলতে দেখা যায়?
মাথার চুল ৭৫%, চোখের পাপড়ি ৫৩%, চোখের ভ্রু ৪২%, যৌনাঙ্গের ১৭%, দাড়ি ১০%, গোঁফ ৭%, বাহু ১০%, পা ৭%, বুকের চুল ৩%, পেটের চুল ২%। কম বেশী হলেও, চিত্রটি প্রায় এ রমকই হয়ে থাকে।
সামাজিক অস্বস্তি
আক্রান্ত মানুষটি তার তুলে ফেলা চুলের অংশটুকু ঢাকার জন্য সব সময় তটস্থ থাকেন। পরচুলা লাগানো কিংবা চুলের আঁচড়ানোর স্টাইলটাই এমন করে করার চেষ্ট করেন যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়। অনেকে এমনকি পানি বা বাতাসের ভেতর যেতে চাান না,সামাজিক অনুষ্ঠানে বিব্রতবোধ করেন। নিজেকে বা সমস্যাটিকে লুকিয়ে রাখার সমস্ত চেষ্টা তার করে থাকেন। অনেক সময় এ রোগটির সাথে অন্যান্য মানসিক রোগও তৈরি হতে পারে।
বিশেষ গ্রুপ
এদের ভেতর একটি গ্রুপ আছে যারা তুলে ফেলা চুল খেয়ে ফেলেন। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। পেটের ভেতর আটকে গিয়ে, গুল্লা পাকিয়ে ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন করতে পারে। পেটের ভিতরের টিউব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেকে চুল তোলার পর কামড়ানোর অভ্যাস আছে, তাতেও ক্ষতি। দাঁতের সব ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
চিকিৎসা
সাইকো এডুকেশন
চিকিৎসার বড় অন্তরায় হলো, আক্রান্ত মানুষটি যেহেতু অন্য সবকিছুতেই স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, কোন অসুবিধা ছাড়াই। তাই তার এ ব্যাপারটি ভিতরে ভিতরে চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছুতেই তারা চিকিৎসার মুখোমুখি হতে চান না। এমনকি চিকিৎসকের সামনে প্রকাশও করতে চান না। অনেকে ভাবে, এসবের আবার চিকিৎসা কিসের! তাই পরিবারের লোকজন বা রোগীর মধ্যে, এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
ওষুধ ও সাইকোথেরাপী
অনেকটা ওসিডি এর মতোই হয়ে থাকে এরোগের চিকিৎসা। সেরোটোনিন রিপআপটেক ইনহিবিটর ও কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। হ্যাবিট রিভার্সাল থেরাপিও এ রোগের চিকিৎসার জন্য উপকারী।
সতর্কতা
অনেকে এই রোগকে চর্মরোগ বলে ধরে নেয়। অনেকে চর্মরোগের ডাক্তারও দেখান। মনে রাখতে হবে নিজে নিজে চুল তুলে ফেলা আর এমনিতে চুল পরে যাওয়া এক বিষয় নয়। ফলে চিকিৎসা শুরু করতেও দেরি হয়।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।