খাদ্যাভ্যাসের কারণে মানসিক সমস্যা

‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ মানে শুধু অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নয়। এরসঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানসিক সমস্যা। ছবিঃ হাস্টন পাবলিক মিডিয়া

খাদ্যাভ্যাসজনীত সমস্যা বা ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’য়ের ধরন হয় একাধিক। আর এসবের পেছনের কারণগুলোও একে অপরের থেকে ভিন্ন।

 ‘হ্যালোগিগলস’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট’ এবং ‘জয় ফ্রম ফিয়ার’ বইয়ের রচয়িতা ডা. কারলা ম্যারি ম্যানলি বলেন, “ইটিং ডিজঅর্ডার’ এক ধরনের মানসিক সমস্যা। এর মূল বৈশিষ্ট্য হল দীর্ঘদিন ঘরে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর এক অভ্যাস গড়ে তোলা। আর সেই বদভ্যাসের পেছনের কারণটা প্রচণ্ড আবেগতাড়িত কোনো চিন্তাধারা।”

“এই মানুষগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের চিন্তাই হয় খাবার, শারীরিক ওজন, মানুষ তাদের শারীরিক অবস্থাকে কীভাবে দেখছে, ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা আর কিছু ক্ষেত্রে শরীরচর্চা।”

আরেক ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডা. জশুয়া ক্লাপো বলেন, “ইটিং ডিজঅর্ডার’য়ে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাসকে অনুসরণ করবে। তবে ওই বিশেষ খাদ্যাভ্যাস তার জীবনের অন্যান্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এখন ওই ব্যক্তি নিজেই হয়ত জানেন যে তার খাদ্যাভ্যাস অস্বাস্থ্যকর এবং তিনি হয়ত তা পরিবর্তনও করতে চান। কিন্তু নিজের চেষ্টায় কিছুতেই পারেন না, প্রয়োজন হয় পেশাদার সাহায্য।”

সমস্যার কারণ

ডা. ম্যানলি বলেন, “জিনগত আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মিলিত প্রভাবে ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ দেখা দেয় বলেই ধারণা করা হয়। জীবনের কোনো প্রচণ্ড কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকেও খাবারের সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। আবার মাদকাসক্তি এবং মানসিক অস্বস্তি ও ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি)’র মতো মানসিক রোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ দেখা দিতে পারে।”

ক্লাপো বলেন, “খাবারের সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক সম্পর্ক একজন ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেও সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। একটা পরিবারের মানুষ তাদের প্রতিদিনকার খাবার কীভাবে তৈরি, সংরক্ষণ, খাওয়া হয় তার ওপর ভিত্তি করেও খাবারের সঙ্গে অস্বাভাবিক বা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।”

“বাবা মায়ের খাদ্যাভ্যাস যদি অস্বাস্থ্যকর হয়, খাবারের সঙ্গে কোনোভাবে যদি শাস্তি জুড়ে দেওয়া হয়, শারীরিক ওজন ও সৌন্দর্য নিয়ে অস্বাভাবিক প্রত্যাশা ও মন্তব্য করা হয় তবে সেটাও হতে পারে ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ সুত্রপাতের কারণ।”

কয়েকটি ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’

বিন্জ ইটিং ডিজঅর্ডার (বিইডি): দীর্ঘদিন ধরে অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে খাবার খাওয়ার অভ্যাস চালিয়ে যাওয়াকে বলা হয় ‘বিনজ ইটিং ডিজঅর্ডার (বিইডি)’।

ডা ম্যানলি বলছেন, “একজন মানুষ সারাদিন হয়ত স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসই মেনে চলেন। কিন্তু রাতে তার সেই ব্যক্তিকে আসক্তি ভর করে। সেটা হতে পারে কিছু না কিছু খাওয়ার আসক্তি, আবার হতে পারে নিজেকেই শাস্তি দেওয়ার একটা পদ্ধতি।”

সপ্তাহে একদিন অতিরিক্ত খাওয়া, যখন প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষুধাই নেই, লুকিয়ে খাওয়া যাতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে না হয়, দ্রুত খাওয়া এবং খাওয়া শেষে নিজের প্রতি অপরাধবোধ, ঘৃণা দেখা দেওয়া ইত্যাদি সবই ‘বিনজ ইটিং ডিজঅর্ডার’য়ের উপসর্গ।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইটিং ডিজঅর্ডার অ্যাসোসিয়েশন’য়ের মতো, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এই ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ বেশি দেখা যায়।

চিকিৎসার ব্যাপারে ম্যানলি বলেন, “এই রোগের চিকিৎসার কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। সকল খাদ্যাভ্যাসজনীত রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ’ নেওয়া হয়।

চিকিৎসক দলের মধ্যে থাকেন ডাক্তার, ‘সাইকোলজিস্ট’, পুষ্টিবিদ, ‘সায়কায়াট্রিস্ট’। ‘থেরাপি’র মধ্যে থাকে ‘কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি’, ‘ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি’, ‘ফ্যামিলি থেরাপি’ ও ‘সাইকোফার্মাকোলজি’।”

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা: ম্যানলি বলেন, “এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে সেচ্ছার অভুক্ত রেখে শারীরিক ওজন এত নামিয়ে আনেন যা একজন মানুষের বয়স, উচ্চতা এবং বিকাশ অনুয়ায়ী যতটুকু ওজন হওয়া উচিত তার থেকে ১৫ শতাংশ বা ততোধিক শতাংশ কম হয়।”

‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ দুই ধরনের, ‘রেস্ট্রিক্টিং টাইপ’ আর ‘কম্পালসিভ এক্সারসাইজ’।

‘রেস্ট্রিক্টিং টাইপ’য়ে রোগী অভু্ক্ত থেকে কিংবা খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলেন। আর ‘কম্পালসিভ এক্সারসাইজ’ হল অস্বাভাবিক মাত্রায় শারীরিক কসরত।

ডা. ক্লাপো বলেন, “আরেকটি ধরন হলো কালেভদ্রে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া। এই মানুষগুলোর খাবার বেশি খেয়ে ফেলা এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার আতঙ্ক থাকে মাত্রাতিরিক্ত।

তিনি আরও বলেন, “শারীরিকভাবে ‘অ্যানোরেক্সিয়া’র কারণে অস্বাভাবিক ‘ব্লাড কাউন্ট’, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, হৃদযন্ত্রের তাল হয় অনিয়মিত, দাঁত নষ্ট হয়, পানিশূন্যতা ও অনিদ্রা ভোগায়।”

এছাড়াও নানান সমস্যা দেখা যায় রোগীদের মাঝে।

চিকিৎসার শুরুতে হাসপাতালে ভর্তি করে তার শারীরিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হয় এবং তার বিপাকক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা হয়।

রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল হলে তাকে ‘ইন্টেনসিভ বিহেভিওরাল অ্যান্ড কগনিটিভ থেরাপি’ দেওয়া হয় যাতে তাদের খাদ্যাভ্যাসকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।

বুলিমিয়া নার্ভোসা: ডা. ম্যানলি বলেন, “এই সমস্যায় আক্রান্ত রোগী বিরতি দিয়ে অত্যন্ত কম ক্যালরির খাবার খায়, আবার তার পরপরই প্রচুর ক্যালরিযুক্ত খাবার খায় অতিরিক্ত মাত্রায়। অতিরিক্ত খাওয়া শেষে তারা জোর করে বমি করে, অভুক্ত থাকে, অতিরিক্ত ‘ল্যাক্সেটিভ’ গ্রহণ করে কিংবা অমানুষিক শরীরচর্চা করে। ওজন না বাড়ে বরং আরও কমে এই আশায় তারা এমনটা করে।”

তিনি আরও বলেন, “‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’তে আক্রান্ত রোগীর মতো এরাও নিজেদের শারীরিক ওজন ও আকৃতি নিয়ে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর ও সতর্ক। এদের ওজন আবার হতে পারে গড়পড়তা থেকে শুরু করে ‘ওবেসিটি’ মাত্রার।”

আর এই কারণে রোগীর আশপাশের মানুষগুলো তাদের এই সমস্যা শনাক্ত করতে পারেন না।

এদের শনাক্ত করার জন্য খেয়াল রাখতে হবে, প্রায়শই ডায়রিয়া, ‘ডাই-ইউরেটিক’, ‘ল্যাক্সেটিভ’ ‘ডায়েট পিল’ ইত্যাদি ওষুধের অপব্যবহার, খাওয়ার পরপরই শৌচাগারে লম্বা সময় পার করা, দীর্ঘদিন গলা ব্যথা, দাঁত নষ্ট হওয়া, বুক জ্বালাপোড়া ইত্যাদি ইঙ্গিত দেখে।

ক্লাপো বলেন, “এই ‘বুলিমিয়া’র আরেকটি ধরন হল ‘এক্সারসাইজ বুলিমিয়া’। যে রোগী মাত্রাতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ঘটনা পুষিয়ে নিতে অমানসিক শরীরচর্চা করে। এই মানুষগুলো ভারি খাবার খাওয়ার অপরাধবোধের তাড়নায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীরচর্চা করতেই থাকে।”

এদের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে খাবারের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। খাবার থেকে দূরে না সরিয়ে স্বাস্থ্যকার খাদ্যাভ্যাস গড়ে দেওয়া হয়।

  

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleভাই-বোনের মতের অমিল, সমাধানের উপায়
Next articleমন শান্ত করার পন্থা  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here