খাদ্যমূল্য বজায় রেখে রান্না

0
15

মোস্তফা কামাল
শিক্ষক ও ভেষজবীদ

খাদ্যমূল্য বজায় রেখে কিভাবে রান্না করতে হবে এটা সকলেরই জানা প্রয়োজন। খাদ্যকে সুস্বাদু ও নির্দোষ করতে গিয়ে আমরা তার খাদ্যগুণ নষ্ট করে ফেলি। রান্না করা খাদ্যের গন্ধে অথবা সেটা দেখা মাত্রই আমাদের মুখে এবং পাকস্থলীতে জারক রসের ক্ষরণ হয়ে থাকে। এই কারণে রন্ধনকৃত খাদ্য আমাদের পরিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে। মাংস এবং অনেক তরিতরকারির তন্ত্র খুব শক্ত থাকে বলে কাঁচা অবস্থায় পাকস্থলী সে তন্ত্রগুলো পরিপাক করতে পারে না। রন্ধন প্রণালীর দোষ ও গুণ খাদ্য উপাদানগুলোর উপর বেশ প্রভাব ফেলে। যেমন: শ্বেতসার ও শর্করা জাতীয় খাদ্যঃ এই ধরনের খাদ্যের কণাগুলো বেশ শক্ত। কাঁচা অবস্থায় এগুলো হজম করা বেশ কঠিন। পানি এবং তাপের প্রভাবে এর দানাগুলো ফুলে ফেঁপে নরম হয়ে যায়। ফলে হজমের সুবিধা হয়। শস্যকণা বা আলুর শ্বেতসার সাধারণতঃ একটি কঠিন আবরণে ঢাকা থাকে। কাঁচা অবস্থায় আমাদের লালার মধ্যভাগে টায়ালিন ঐ শ্বেতসারের উপর কোন ক্রিয়া করে না। রান্নার ফলে এই আবরণটি ফেটে যায় এবং শ্বেতসার বের হয়ে আসে। তখন টায়ালিন ঐ শ্বেতসার ভেঙ্গে গ্লুকোজ উৎপন্ন করে। এই জন্য শ্বেতসার রান্না করেই খাওয়া উচিত। উত্তাপের ফলে এই জাতীয় খাদ্যের কিছু অংশ সহজপাচ্য ডেস্ট্রিন শর্করায় পরিণত হয়। একারণেই কাঁচা পাউরুটির চাইতে সেঁকা পাউরুটি অথবা টোস্ট ও বেলা বিস্কুট হজম করা সহজতর। আমিষ জাতীয় খাদ্যঃ রান্নার ফলে প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্য বেশ রূপান্তরিত হয়। তাপে এধরনের খাবার জমে যায়। যেমন: ডিমের সাদা অংশ যেটাকে এলবুমিন বলা হয়। মাংস নরম ও সহজপাচ্য হয়। উদ্ভিজ প্রোটিন ভালো করে রান্না করলে হজমের সুবিধা হয়। কাঁচা ডাল অপেক্ষা সুসিদ্ধ ডালের প্রোটিন আমাদের শরীর ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে। মাছ, মাংস, ডিম রান্নার প্রভাবে সঙ্কুচিত হয়ে জমাট বেঁধে যায় বলে সহজেই পরিপাক হয়।

Magazine site ads

চর্বি জাতীয় খাদ্য: অতিরিক্ত তেল-ঘি দেহের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো পরিপাকে তাপের কোন প্রভাব নেই। তবে কারো কারো মতে দুধ ও তেল বারে বারে ফোটালে বিষাক্ত হতে পারে।

মাংস রান্না করলে এর স্নেহ পদার্থটুকু বের হয়ে ঝোলের সঙ্গে মিশে যায়। তবে ভেতরের প্রোটিন ঠিকই থাকে।

ভিটামিন এ : সাধারণ রান্নায় ক্ষয় না হলেও উচ্চতাপে যেমন উত্তপ্ত কড়াইতে ঘি-মাখন দিলে কিছুটা হলেও এ ভিটামিন নষ্ট হয়।

ভিটামিন সি : এই ভিটামিন তাপে সংবেদনশীল। অনেকক্ষণ ধরে খোলা কড়াইতে রান্না করলে এর খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। দুধের মধ্যে যেটুকু ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে দুধ বারে বারে ফোটালে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। দেখা গেছে রান্নার ফলে শতকরা ১০-১০০ ভাগ পর্যন্তও ‘সি’ ভিটামিন নষ্ট হয়। শাক-সবজির ভিটামিন রক্ষার পথ হলো বেশি কুচি না করে ঢাকা দেয়া পাত্রে তাড়াতাড়ি রান্না করা। অল্প আঁচে বেশিক্ষণ ধরে রাঁধলে খাবারের ‘সি’ ভিটামিন ৩০ ভাগ পর্যন্ত অপচয় ঘটে। তামার পাত্রে রান্না করলে ভিটামিন ‘সি’ একেবারেই থাকে না।

ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন: এই ভিটামিন যুক্ত খাবার সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিলে এর খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। গরমে বেশিক্ষণ রেখে দিলে বা উচ্চতাপে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করলে থায়ামিন ক্ষয় হয় শতকরা ২৫-৭৫ ভাগ। রান্নায় সোডা ব্যবহার করলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয় বলে এর জ্বালানি খরচ কম হয় বটে, তবে খাদ্যগুণ একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং বহুল জনপ্রিয় খাদ্য চটপটি জিনিসটির খাদ্যমূল্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ডালের বি-ভিটামিন সাধারণ রান্নার ফলে কিছু নষ্ট হয়। অঙ্কুরিত ছোলা, মটর, মুগ খুবই পুষ্টিকর। এজন্য এ সমস্ত ডাল ভালো করে ধুয়ে অঙ্কুরিত করবার সময় যে পানিটুকু ব্যবহার হয়েছিল সেটা যেন ফেলতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাঙালীর রান্নায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞতা থাকলেও বিশেষত্ব যে একেবারেই নেই তা নয়। এ ধরনের খাদ্য পুষ্টি রক্ষার ক্ষেত্রে শুধু অনুকূলই নয়, স্বাস্থ্যের পক্ষে হিতকরও বটে। যেমন: চাল + গুড় দুধ মেশানো পায়েস অথবা পিঠা কেবলমাত্র খেতেই সুস্বাদু নয়। পরমান্নও বটে। একই ভাবে ডালের সাথে নারিকেল, আলু, মটরশুটি, সীম, ডাটা, শাক কিংবা মাছের মাথা দিয়ে ডাল শুধু উপাদেয় নয়, এগুলোর সংমিশ্রণে খাদ্যমূল্য অনেকগুণ বেড়ে যায়। আবার চাল + ডাল + সবজি মেশানো খিচুড়ী নানারকম অসম্পূর্ণ  প্রোটিনকে সম্পূর্ণ প্রোটিনে রূপান্তরিত করে দেহের ক্ষয়রোধ করে। এই খাবার রোগা ছেলে-মেয়েদের জন্য খুবই উপকারী। সরষের তেল এবং সরষে বাটা দিয়ে রান্না বাঙালীর ঐতিহ্য। এর ব্যবহার খাবারকে সুস্বাদু করে বলে ঘরে ঘরে এর সমাদর রয়েছে। লোহার কড়াইতে রান্না করা তরকারিতে কড়াইর লোহা যুক্ত হয়ে অ্যানিমিয়ার প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে।মনের খবর ম্যগাজিনে

রান্নায় জীবাণুর উপর প্রভাব: খাদ্যের সঙ্গে যে সব রোগজীবাণ থাকে তা থেকে টাইফয়েড, কলেরা, পেটের অসুখ, কৃমি যক্ষ্মা ইত্যাদি নানারকম রোগ হতে পারে। রান্নার ফলে এই জীবাণুগুলি ধ্বংস হয়। তবে এমন কিছু জীবাণু আছে যা তাপেও বিনষ্ট হয় না। যেমন : বটুলিন। সেজন্য রান্নার পূর্বে একটু পটাশ পারম্যাঙ্গানেট মেশানো পানি দিয়ে শাক-সবজি ও ফল ধুয়ে নিলে ভালো হয়। ধান সিদ্ধ করে যে সিদ্ধ চাল আমরা পাই, সেটাতে চালের কীটপতঙ্গ ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এ কারণে সিদ্ধ চাল বেশিদিন গুদামজাত করা সম্ভব। আবার সুজিকে খালি তাওয়ায় ভেজে রাখলে পোকা হওয়ার ভয় থাকে না। রান্নার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম-কানুন যদি জানা থাকে তবে পুষ্টির অপচয় রোধ করা সম্ভব।

১। রান্না করা তরকারি গরম রাখবার জন্য চুলার উপর বসিয়ে রাখলে খাদ্যগুণের অপচয় ঘটে। এজন্য রান্না শেষ হওয়ার পর পরই খাবার খেয়ে ফেলা উচিত।

২। প্রেসার কুকারে রান্না করলে খাদ্যের মান অনেকখানি বজায় থাকে। মাড় না ফেলে ভাত এবং পানি না দিয়ে সবজি রান্না হয় বলে ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি পড়ে না। তবে একমাত্র রাইবোফ্লাভিনটাই নষ্ট হয়। এর কারণ প্রেসার কুকারের উচ্চতাপ। হিমায়িত মাংস রান্না হতে সময় বেশি লাগে বলে এটি প্রেসার কুকারে রান্না করাই শ্রেয়।

৩। তরিতরকারি সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিলে খনিজ লবণের অপচয় হয়। অর্থাৎ পানির সঙ্গে সেই লবণ বের হয়ে যায়। আবার কোন কোন খনিজ লবণের খাদ্যমূল্য রান্নার ফলে উন্নতও হয়।

৪। সবজি না ভেজে সিদ্ধ করে খেলে পুষ্টির অপচয় কম হয়।

৫। ডাল ভালভাবে সিদ্ধ না হলে হজমে গোলযোগ দেখা দেয়।

৬। রান্নার বহু আগে তরকারি কাটা অথবা মাছ/মাংস ধুয়ে রাখা উচিত নয়। এতে বায়ু ও অক্সিজেনের সংস্পর্শে খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। অধিক নাড়াচাড়া করা খাদ্যের ক্ষেত্রেও একই বিপর্যয় ঘটে।

আরও দেখুন- 

Previous articleজীবনের ফাঁদে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি, কায়দা করেও আর যেন বাঁচতে পারছি না!
Next articleঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ঘিরে বিএপির নববর্ষের আয়োজন আগামীকাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here